অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা, শরীরচর্চার অভাব, ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া না করা, অনেক রাত পর্যন্ত জাগা, ওবেসিটি প্রভৃতি আরও কারণ ডায়াবেটিস হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আর এ কারণেই ডায়াবেটিসকে প্রথম সারির লাইফস্টাইল ডিজিজ হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন চিকিৎসক মহল।
এখন প্রশ্ন হল, এমন রোগের খপ্পরে না পড়তে চাইলে তার জন্য কী করা যেতে পারে?
জীবনযাত্রার সঙ্গে যেহেতু এই রোগের সরাসরি যোগ রয়েছে, তাই যে কোনও নিয়ম মানা শুরু করার আগে জীবন শৈলীতে পরিবর্তন আনাটা জরুরি। না হলে কিন্তু কোনও উপকারই পাবেন না। তাই ঘুম থেকে খাওয়া-দাওয়া, এইসব ছোটখাট বিষয়গুলির দিকে আগে নজর দিতে হবে। সেই সঙ্গে মেনে চলতে যে নিয়মগুলি, সেগুলি হল
১. প্রতিদিন বাদাম খেতে হবে: এতে উপস্থিত আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট, প্রোটিন এবং একাধিক ভিটামিন, শরীরে প্রবেশ করে একদিকে যেমন খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমতে শুরু করে, তেমনি ইনসুলিনের কর্মক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই রক্তে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা যায় কমে।
২. কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবার কম খেতে হবে: ভাতের মতো কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবার বেশি করে খেলে শরীরে হঠাৎ করে শর্করার মাত্রা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কারণ কার্বোহাইড্রেট শরীরে প্রবেশ করার পর দেহ তাকে ভেঙে চিনিতে রূপান্তরিত করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সুগার এর মাত্রা বেড়ে যায়। সেই কারণেই তো পরিবারে ডায়াবেটিস রোগের ইতিহাস থাকলে ভাত খেতে মানা করেন চিকিৎসকেরা।
৩. প্রতিদিন বার্লি খাওয়া মাস্ট: এতে রয়েছে প্রচুর মাত্রায় ফাইবার, যা দীর্য সময় পেট ভরিয়ে রাখে। সেই সঙ্গে শর্করার মাত্রা যাতে ঠিক থাকে, সেদিকেও খেয়াল রাখে। তাই তো ডায়াবেটিকদের এই খাবারটি খাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা।
৪. ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি যেন না হয়: শরীরে এই ভিটামিনটির ঘাটতি দেখা দিলে ইনসুলিন রেজিসটেন্সের আশঙ্কা থাকে। আর এমনটা হলে রক্ত সুগারের মাত্রা বাড়তে শুরু করে। তাই আজ থেকেই ভিটামিন-ডি সমৃদ্ধ খাবার, যেমন- মাছ, দুধ, কমলা লেবুর রস, সোয়া দুধ এবং ডিম খাওয়া শুরু করুন। প্রয়োজনে চিকিৎসকের সঙ্গে একবার এই বিষয়ে পরামর্শ করে নিতে পারেন।
৫. প্রতিদিন হাঁটতে হবে: প্রতিদিন সকালে এবং বিকালে ১৫ মিনিট করে হাঁটলেই দেখবেন সুগার লেভেল নর্মাল হয়ে যাবে। তাই ডায়াবেটিকদের এই একটি বিষয়ে নজর রাখতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না যে শরীরচর্চার সঙ্গে এই রোগের বাড়া-কমা অনেকাংশেই নির্ভর করে।
৬. ফাইবার জাতীয় খাবার বেশি করে খেতে হবে: একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে বেশি মাত্রায় ফাইবার রয়েছে এমন খাবার বেশি মাত্রায় খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। সেই সঙ্গে হজম ক্ষমতার যেমন উন্নতি ঘটে, তেমনি ওজনও কমতে শুরু করে। প্রসঙ্গত, ডাল, ব্রকলি, স্প্রাউট, জাম, অ্যাভোকাডো, হোল হুইট পাস্তা এবং ওটস মিলে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে।
৭. মেথি খাওয়া জরুরি: প্রতিদিন সকালে এক গ্লাস গরম দুধে ১ চামচ মেথি পাউডার মিশিয়ে খাওয়া শুরু করুন। অল্প দিনেই দেখবেন ডায়াবেটিস একেবারে নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। কারণ মেথিতে উপস্থিত বিশেষ কিছু উপাদান দ্রুত শর্করার মাত্রা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
৮. সবুজ শাক-সবজি: যেসব সবজিতে স্টার্চের পরিমাণ কম রয়েছে, তেমন সবজি বেশি করে খেলে রক্তে সুগারের মাত্রা কমতে শুরু করে। এক্ষেত্রে পালং শাক, কর্নফ্লাওয়ার, লেটুস প্রভৃতি দারুন কাজে আসে।
৯. অ্যালো ভেরা, সঙ্গে হলুদ: পরিমাণ মতো হলুদ গুঁড়োর সঙ্গে অ্যালো ভেরা জুস, অল্প করে তেজপাতা এবং পানি মিশিয়ে একটা পানীয় বানিয়ে ফেলুন। প্রতিদিন রাতে খাবারের আগে এই পানীয়টি খেলে ডায়াবেটিস একেবারে নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
১০. রোজের ডায়েটে ফল থাকতে হবে: জুস না খেয়ে ফল খাওয়া শুরু করুন। আসলে ফল খেলে শরীরে যে পরিমাণ ফাইবার যায়, তার থেকে অনেক কম যায় জুস খেলে। আর একথা তো সবাই জানেন যে শরীরে ফাইবারের পরিমাণ যত বাড়বে, তত নানাবিধ রোগ দূরে থাকবে। সেই সঙ্গে কমবে শর্করার মাত্রাও।
১১. দৈনিক ৩-৪ লিটার পানি পান করতে হবে: রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে বেশি করে পানি পান করতে হবে। কারণ শরীরে পানির পরিমাণ যত কমবে, তত কিন্তু পরিস্থিত হাতের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা বাড়বে। তাই ডায়াবেটিকদের এই বিষয়টি মাথায় রাখা একান্ত প্রয়োজন।
যেসব লক্ষণ দেখে বুঝবেন আপনার শরীরে ডায়াবেটিস
ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ। যাকে বলা হয় নীরব ঘাতক। ওষুধ, শরীরচর্চা ও খাওয়া-দাওয়া নিয়ম মেনে করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে। তবে ডায়াবেটিস কোনোভাবেই পুরোপুরি নিরাময় করা সম্ভব নয়। তাই সঠিক সময়ে শারীরিক লক্ষণগুলো চিহ্নিত করে ডায়াবেটিসের উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারলে দ্রুত চিকিৎসার মাধ্যমে দীর্ঘ স্বাভাবিক জীবন পাওয়া সম্ভব। আসুন ডায়াবেটিসের প্রাথমিক লক্ষণগুলো এক নজরে দেখে নেওয়া যাক –
তৃষ্ণা ও প্রস্রাবের মাত্রা বৃদ্ধি : পিপাসা বেড়ে যাওয়া বা ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ পাওয়া ডায়াবেটিস রোগের দুটি সাধারণ লক্ষণ। সাধারণত একজন সুস্থ মানুষ সারাদিনে ৬-৭ বার প্রস্রাব করেন। পরিবেশ বা পরিস্থিতি পরিবর্তনে দিনে ৪-১০ বার প্রস্রাবকেও স্বাভাবিক ধরা হয়। তার বেশি হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া : ডায়াবেটিসের তিনটি প্রধান লক্ষণের মধ্যে অন্যতম হলো ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া। বারবার খাবার খাওয়ার পরেও ক্ষুধা ক্ষুধা ভাব থেকে যায়। এমন হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
অবসাদ বা ক্লান্তি বোধ : পর্যাপ্ত ঘুমের পরেও যদি সারাদিন অস্বাভাবিক ক্লান্ত বোধ করেন তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। কারণ ডায়াবেটিসের ফলে শরীর পর্যাপ্ত গ্লুকোজ পায় না। পাশাপাশি অতিরিক্ত প্রস্রাবের ফলে শরীরে পানির ভারসাম্য নষ্ট হয়। তাই শরীর ক্লান্ত ও অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
অস্বাভাবিকভাবে ওজন হ্রাস : খাদ্যাভ্যাসে কোনো ধরনের বিশেষ পরিবর্তন বা শরীরচর্চা ছাড়াই অস্বাভাবিকভাবে ওজন কমে যাওয়া ডায়াবেটিসের একটি অন্যতম লক্ষণ। ডায়াবেটিসের ফলে শরীর পর্যাপ্ত গ্লুকোজ পায় না। শরীরে প্রয়োজনীয় শক্তির ঘাটতি দেখা দেয়। আর সেই ঘাটতি পূরণের জন্য শরীর তার ফ্যাট ব্যবহার করা শুরু করে। ফলে শরীর ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে ও ওজন কমতে থাকে।
ত্বকে কালচে ভাব : অ্যাকান্থসিস নিগ্রিকানস হলো ত্বকের এক ধরনের সমস্যা, যার ফলে ত্বকের উপরিভাগের কিছু অংশে পিচ্ছিলভাব তৈরি হয় ও সেখানে কালো ছোপ পড়তে থাকে। ত্বকের এই সমস্যা সাধারণত ঘাড়, কনুই, বগল, আঙুল, হাঁটুর পেছনের অংশে বেশি দেখা যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ত্বকের এই সমস্যাকে ডায়াবেটিসের প্রাথমিক উপসর্গগুলোর একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ত্বকে চুলকানি ভাব : ডায়াবেটিসের ফলে শরীরে পানির ভারসাম্য নষ্ট হয়। ফলে ত্বক শুষ্ক ও রুক্ষ হয়ে পড়ে। শুষ্ক ত্বকের উপরিভাগে সংক্রমণ দেখা দেয়। ত্বকে চুলকানি, জ্বালাভাব অস্বস্তি তৈরি করে। ত্বকের সংক্রমণ বা চুলকানির আর একটি কারণ হলো ইস্ট ইনফেকশন, যেটি ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে খুবই স্বাভাবিক সমস্যা।
অস্পষ্ট দৃষ্টিশক্তি : দৃষ্টি হঠাৎ করে যদি অস্পষ্ট বা ঝাপসা হতে থাকে এবং তার জন্য যদি চোখের কোনো সমস্যা না থাকে, তবে বুঝতে হবে ডায়াবেটিসের সমস্যার জন্যই এমনটা হচ্ছে। শরীরের অভ্যন্তরে তরলের মাত্রার তারতম্য হওয়ায় চোখ ফুলে যায়। ফলে দৃষ্টি হঠাৎ করে অস্পষ্ট বা ঝাপসা হতে থাকে। এমন হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
ক্ষতস্থান নিরাময়ে সময় লাগা : শরীরের যেকোনো কাটা-ছেঁড়া ও ক্ষতস্থান শুকতে বা সেরে উঠতে যদি অনেক বেশি সময় লাগে তবে তা ডায়াবেটিসের প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হয়। এমন হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ডায়াবেটিস রোগীদের হাঁটার সঠিক সময় কোনটি?
ডায়াবেটিস এখন অত্যন্ত প্রচলিত একটি বিষয়। সব মানুষই এ বিষয়ে সাধারণ তথ্যগুলো জানেন। তার পরও এর চিকিৎসা পদ্ধতিতে নতুন নতুন বিষয় সংযোজন হচ্ছে। ডায়াবেটিসের চিকিৎসার নতুন পদ্ধতি নিয়ে কথা বলেছেন স্কয়ার হাসপাতালের ইন্টারনাল মেডিসিন অ্যান্ড ডায়াবেটিসের পরামর্শক ডা. জাহাঙ্গীর আলম।
প্রশ্ন : একজন মানুষকে কখন আপনারা ডায়াবেটিস রোগী বলছেন?
উত্তর : ডায়াবেটিস নির্ণয়ের জন্য এখন তিনটি পরীক্ষা প্রচলিত রয়েছে। একটি হচ্ছে, খালি পেটে রক্তের শর্করা ৭ দশমিক ১-এর ওপরে যদি থাকে। ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা সারা রাত খালি পেটে থাকতে হবে। দ্বিতীয় হচ্ছে, খাওয়ার দুই ঘণ্টা পরে, যদি সুগার ১১-এর ওপরে থাকে। আর আরেকটি হলো এইচবিএওয়ানসি, অর্থাৎ তিন মাসের গড় যদি ৬ দশমিক ৫-এর ওপরে থাকে, তাহলে আমরা রোগীকে ডায়াবেটিস বলতে পারি। তবে এই প্রতিবেদনগুলো যখন দ্বান্দ্বিক হয়, তখন আমরা ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাইয়ে দুই ঘণ্টা পর পরীক্ষা করে দেখি সুগারটা কত রয়েছে। একে জিটিটি বলা হয়।
প্রশ্ন : ডায়াবেটিস যদি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, আমরা জানি এটি বড় কোনো সমস্যা নয়। নিয়ন্ত্রণে না থাকলে এটি অনেক সমস্যা তৈরি করে। নিয়ন্ত্রণের জন্য আপনারা কী করেন?
উত্তর : প্রথমে জেনে নেওয়া দরকার, ডায়াবেটিস হচ্ছে সারা জীবনের রোগ। এটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য। তবে নিরাময়যোগ্য নয়। তাই প্রথমে জানতে হবে, ডায়াবেটিস আমার শরীর থেকে যাবে না। যদি ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকে, তাহলে মাথা থেকে পা পর্যন্ত এমন কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেই, সে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না। আমরা যদি মস্তিষ্কের কথা ধরি, আপনার যদি ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকে, তাহলে স্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মস্তিষ্কের রক্তের নালিগুলো চিকন হয়ে যাবে। অনেক জটিলতা হবে।
হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। চোখের অন্ধত্ব হতে পারে। এর পর কিডনি বিকল হতে পারে। পায়ের রক্তের নালিগুলো যখন চিকন হয়ে যায়, পায়ে পচন ধরবে। সুতরাং আমরা যদি ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণে রাখি, এই জটিলতাগুলো সাধারণত হয় না। অথবা হলেও দেরিতে হয়। এবং আমরা সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে পারি।
প্রশ্ন : নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কী করেন?
উত্তর : নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ডায়াবেটিসের চিকিৎসা পদ্ধতিতে তিনটি জিনিসের একসঙ্গে সমন্বয় করতে হয়। একটি হচ্ছে খাদ্য নিয়ন্ত্রণ। আমরা জানি, ডায়াবেটিস হচ্ছে মূলত শর্করার জাতীয় খাদ্যের বিপাকজনিত সমস্যা। এর সঙ্গে চর্বি ও প্রোটিনেরও সমস্যা থেকে যায়। তবে মূল সমস্যা হচ্ছে কার্বোহাইড্রেটের। সুতরাং এখানে খাদ্য নিয়ন্ত্রণের একটি বিষয় রয়েছে। শরীরের ওজন অনুযায়ী খাদ্যের তালিকা দিয়ে দিই। বলে দিই, এত কিলোক্যালরি আপনার খাওয়া উচিত। তবে একটি জিনিস বলে দিই, ডায়াবেটিস হওয়া মানে এই নয় যে আপনি উপোস থাকবেন। আসলে আপনার খাওয়াটা হবে শুধু একটা মাপের খাওয়া, নিয়ন্ত্রণের মধ্যে খাওয়া এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে খাওয়া। তবে অভুক্ত থাকা নয়। এর মধ্যে মিষ্টিজাতীয় যে খাবারগুলো আছে, সেগুলো আপনার স্বাদের তালিকা থেকে মুছে ফেলুন। যেসব খাবার মিষ্টি, সেগুলো পরিহার করার চেষ্টা করবেন।
দ্বিতীয়ত হচ্ছে, খাবারে কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেটগুলো পছন্দ করতে হবে। এদিকে সবজি ও মিনারেলজাতীয় খাবার যেগুলো আছে, এগুলোতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে চর্বিজাতীয় খাবারগুলো যথাসম্ভব কমিয়ে খেতে হবে। এটিও নির্ভর করে আপনার রক্তের কোলেস্টেরল এবং অন্যান্য জটিলতার ওপরে।
এর পর রয়েছে ব্যায়াম। ব্যায়ামকে বলা হয় ডায়াবেটিস ব্যবস্থাপনার লবণ। লবণ না দিলে যেমন খাবারে স্বাদ হয় না, তেমনি ব্যায়াম না করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রিত হয় না। এটাকে অনেকটা মহৌষধও বলতে পারেন। একজন ডায়াবেটিসের রোগীর যদি আমৃত্যু ব্যায়াম করার শক্তি থাকে, তাহলে সারা জীবন তাকে ব্যায়ামের মধ্যে থাকতে হবে।
ডায়াবেটিসের জন্য ব্যায়াম হলো দ্রুত হাঁটা। হাঁটা হতে হবে অন্তত দিনে ৩০ মিনিট। সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন। প্রতি ১০ মিনিটে এক কিলোমিটার হাঁটতে হবে। প্রথম দিকে হয়তো একটু কষ্ট হবে। তবে হাঁটতে হাঁটতে দেখবেন একসময় হয়ে গেছে। হাঁটা থামাবেন না।
প্রশ্ন : হাঁটার বেলায় অনেকে জানতে চান কখন হাঁটা ভালো?
উত্তর : আপনার যদি হৃদরোগ না থাকে, কোনো জটিলতা না থাকে, তাহলে হাঁটার বিষয়টি আপনি পছন্দ অনুসারে করে নিতে পারেন জীবনযাত্রার সঙ্গে। সকালেও হাঁটতে পারেন, বিকেলেও হাঁটতে পারেন। তবে অনেকের মধ্যে দ্বিধা থাকে, সকালবেলা হাঁটলে তো স্ট্রোক হবে বা হার্ট অ্যাটাক হবে। আসলে সেটি নয়। চিকিৎসকের কাছে আপনার শরীর অনুযায়ী একটু জিজ্ঞেস করে নেবেন, কোন সময়টি আপনার হাঁটার জন্য ভালো-সকালে নাকি বিকেলে? আর যাদের কোনো জটিলতা নেই, তারা যেকোনো সময় হাঁটতে পারে, যখন সময় বের করতে পারবে। তবে সকাল বা বিকেল দুটোর একটা বেছে নেওয়াই ভালো।
এ ছাড়া ব্যায়ামের আরো কিছু বিষয় আছে। অনেকে হয়তো বাইরে বেরোতে পারেন না। অথবা তার সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে একটি ট্রেডমিল মেশিন কিনে নিতে পারে। সেই যন্ত্রে ছয় অথবা সাত বেগে আপনি ৩০ মিনিট হাঁটলেন। এ ছাড়া অনেকে জিমে ভর্তি থাকেন। তাঁরা সেখানে সাঁতার কাটতে পারেন। সাইকেল চালাতে পারেন। এ কয়েকটি ব্যায়াম সাধারণত ডায়াবেটিসের জন্য অত্যন্ত ভালো। আর যেগুলো ওয়েট লিফটিং, সেগুলো হলো ফিটনেস ব্যায়াম। সেগুলো ডায়াবেটিসের এতটা উপকার করে না।
প্রশ্ন : আমরা খাওয়া-দাওয়া এবং ব্যায়াম নিয়ে জানলাম। এর পর ওষুধের বিষয়ে আপনারা কী করে থাকেন?
উত্তর : অনেকের হয়তো প্রথম দিকে দেখা যায় এই খাদ্যাভ্যাস এবং ব্যায়াম দিয়ে ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। অনেক রকমের ওষুধ বাজারে প্রচলিত আছে। তবে যেসব ওষুধ বেশি ব্যবহার করে সালফোনাইলিউরিয়া। তবে এগুলো এখন উঠে যাচ্ছে। কেননা, এগুলোর অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। মেটফরমিন অনেক পুরোনো ওষুধ। এ ছাড়া জিএলপি অ্যানালগ, ফরডিপিপি, ইনহিবিটরস এগুলো এখন আশাপ্রদ ওষুধ। নতুন কিছু ওষুধ এসছে এসজিএলটিটু ইনহিবিটরস। এগুলো আমাদের বাজারেও চলে এসেছে। এগুলো ভালো। এগুলো মুখে খাওয়ার ওষুধের সঙ্গে আমরা যোগ করতে পারি। (যেকোনো ওষুধ সেবনের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন)।
প্রশ্ন : ইনসুলিন নিয়ন্ত্রণেও নতুন কোনো পদ্ধতি আছে কী?
উত্তর : হ্যাঁ। এখন নতুন নতুন ইনসুলিন, বিভিন্ন ধরনের ইনসুলিন চলে এসেছে। এগুলো দীর্ঘমেয়াদি কাজ, মধ্যমমেয়াদি কাজ, স্বল্পমেয়াদি কাজের জন্য রয়েছে। ইনসুলিন দেওয়ার বিষয়েও নতুন একটি পদ্ধতি এসেছে। আপনি যদি বহু ডোজে ইনসুলিন নেন, যদি আপনার সুইয়ের ভয় থেকে যায়, আপনি যদি সহ্য করতে পারেন, তবে ইনসুলিন পাম্প চলে আসছে, সেটি ব্যবহার করতে পারেন। পাম্প লাগিয়ে সহজেই দৈনন্দিন কাজ করতে পারবেন। পাম্পে সেটআপ থাকবে, কতটুকু করে ইনসুলিন যাবে। সুতরাং এটিও একটি নতুনত্ব। এটি আমরা রোগীদের দিচ্ছি। এতে অনেক উপকার হচ্ছে। যখন যেটুকু ঘাটতি, ততটুকুই শরীরে দেবে। সমস্যা হলো যে, হাইপোগ্লাইসেমিয়া যখন হবে, তখন পাম্পটা এমনিতেই থেমে যায়।
এ ছাড়া গ্লুকোজ পর্যবেক্ষণ পদ্ধতিতেও নতুনত্ব এসেছে। আমরা তো সাধারণত গ্লুকোমিটার দিয়ে তিন থেকে চারবার চেক করে থাকি। এখন নতুন পদ্ধতি রয়েছে নিয়মিত গ্লুকোজ পর্যবেক্ষণ করার জন্য। ইনসুলিন দেওয়ার আগে আমরা ধারণা করে নিই, কীভাবে ইনসুলিন দেওয়া উচিত। আর আমরা এখন এগুলো অহরহ ব্যবহার করছি।