মাঝে মধ্যেই পেটে ব্যথা হচ্ছে? যখন তখন মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়ে যাচ্ছে? ৬-৭ ঘণ্টা ঘুমানোর পরও অবসাদগ্রস্থ লাগছে? শরীরে সারাক্ষণ একটা অস্বস্তি ভাব? এ সবের কারণ হতে কৃমি। কিন্তু কী করে বুঝবেন, আপনার শরীরে কৃমি বাসা বেঁধেছে কিনা? আসুন কয়েকটি এর কয়েকটি উপসর্গ চিনে নেওয়া যাক…
কৃমির উপসর্গ:
১) মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়ার ইচ্ছা অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যাওয়া,
২) মাড়ি থেকে রক্তপাত হওয়া,
৩) ঘুমনোর সময়ে মুখ থেকে লালা পড়া,
৪) অকারণে ক্লান্ত হয়ে পড়া,
৫) ত্বকে র্যাশ, চুলকুনির সমস্যা,
৬) খিদে না পাওয়া,
৭) গা-হাত-পা ব্যথা,
৮) অনিয়মিত ঋতুর সমস্যা।
শরীরে কৃমির সমস্যা বাড়তে রক্তাল্পতা এবং আয়রন ডেফিশিয়েন্সির আশঙ্কা বেড়ে যায়। কৃমি থাকলে শরীরে রক্তের পরিমাণ কমতে কমতে অ্যানিমিয়া পর্যন্ত হতে পারে। কৃমির জন্য স্মৃতিভ্রম হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
একাধিক গবেষণায় জানা গিয়েছে, প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষের পেটেই কৃমি থাকে। শরীরে কৃমির মাত্রা বৃদ্ধি পেলেই উপরে উল্লেখিত উপসর্গগুলি লক্ষ্য করা যায়। মার্কিন চিকিৎসক আব্রাম বের-এর মতে, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কৃমির সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বেশ কিছু ঘরোয়া উপায়েও কৃমির হাত থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে। আসুন সেগুলি সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক…
কৃমির সমস্যায় কার্যকরী ঘরোয়া সমাধান:
১) কাঁচা হলুদ: কাঁচা হলুদ অ্যান্টিবায়োটিকের কাজ করে। কৃমির সমস্যা নিয়ন্ত্রণে এটি খুবই কার্যকরী একটি উপাদান।
২) কাঁচা রসুন: কাঁচা রসুনে প্রায় ২০ ধরনের ব্যাকটেরিয়া এবং ৬০ ধরনের ফাংগাস মেরে ফেলার ক্ষমতা রয়েছে। তাই নিয়মিত কুচনো কাঁচা রসুন খান। উপকার পাবেন।
৩) আদা: আদা হজমের সমস্ত রকমের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে আনতে খুবই কার্যকরী একটি উপাদান। হজমের সমস্যা, অ্যাসিডিটি, পেটে ইনফেকশন, ইত্যাদি দূর করতে আদার জুড়ি মেলা ভার। কাঁচা আদার রস খান খালি পেটে। কৃমির সমস্যায় দ্রুত ফল পাবেন।
৪) পেঁপে: পেটের সমস্যা দূর করতে পেঁপে অত্যন্ত কার্যকরী একটি উপাদান। যে কোনও ধরনের কৃমি সমস্যায় পেঁপের বীজ অত্যন্ত কার্যকর। কৃমির সমস্যায় দ্রুত ফল পেতে পেঁপে এবং মধু খেতে পারেন।
৫) শশার বীজ: ফিতাকৃমির সমস্যা নিয়ন্ত্রণে আনতে শশার বীজ অত্যন্ত কার্যকর। শশার বীজকে শুকিয়ে গুঁড়ো করে প্রতিদিন এক চা-চামচ করে খান। দ্রুত ফল পাবেন।
কৃমির ওষুধ কখন খাব?
কৃমি আকারে খুবই ছোট। প্রায় দেখাই যায় না। কিন্তু জেনে অবাক হবেন, এ রকম একটি কৃমি মানুষের অন্ত্র থেকে দিনে শূন্য দশমিক ২ মিলিলিটার রক্ত শুষে নেয়। অনেক কৃমি শরীরে থাকলে প্রতিদিনই বেশ কিছু পরিমাণ রক্ত হারিয়ে যায়। ফলে শিশুরা অপুষ্টি ও রক্তশূন্যতায় ভোগে। বড়রাও কম ভোগেন না।
এ ছাড়া কৃমির কারণে অ্যালার্জি, ত্বকে চুলকানি, শুকনো কাশি, শ্বাসকষ্ট হতে পারে। কখনো অন্ত্রের বা পিত্তথলির নালিতে কৃমি আটকে গিয়ে বড় ধরনের জটিলতা হয়। কৃমি সংক্রমণ তাই বড় ধরনের স্বাস্থ্যসমস্যা।
কৃমি দূর করতে হলে প্রথমেই জানা দরকার এটি কেন হয়? নোংরা পরিবেশ, অনিরাপদ পানি পান, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, খালি পায়ে হাঁটা কৃমি সংক্রমণের জন্য দায়ী।
কৃমি হলেও ওষুধের মাধ্যমে দূর করার উপায় আছে। কিন্তু অনেকে নানা ভুল ধারণার জন্য ভয়ে কৃমির ওষুধ খান না। শিশুদেরও খাওয়াতে চান না। কিন্তু ওষুধ নিয়ম মেনে খেলে আর সহজ কিছু উপায় মেনে চললে সহজেই কৃমি দূর করা যায়।
জেনে নেওয়া যাক সহজ কিছু উপায়:
১. প্রতি তিন মাস পরপর পরিবারের সবাই একটি করে অ্যালবেনডাজল বড়ি সেবন করতে পারেন। মেবেনডাজল হলে খেতে হবে পরপর তিন দিন। সাত দিন পর আরেকটা ডোজ খাওয়া যায়। শিশুদেরও একইভাবে সিরাপ খাওয়াতে হবে। দুই বছরের নিচে কোনো শিশুকে খাওয়াতে হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
২. চিনি খেলে বা মিষ্টি খেলে কৃমি হবে বলে যে ধারণা প্রচলিত, তা ঠিক নয়। মিষ্টি বা চিনি খাওয়ার সঙ্গে কৃমির কোনো সম্পর্ক নেই। বরং নোংরা হাতে বা অস্বাস্থ্যকর খাবার খেলে কৃমি হবে।
৩. কৃমি হলে পায়ুপথ চুলকায় বলে শিশুরা সেখানে হাত দেয়। পরে আবার সেই হাত মুখে দেয়। এভাবেই সংক্রমণ ছড়াতে থাকে। তবে পায়ুপথ চুলকানো মানেই কৃমি সংক্রমণ নাও হতে পারে। কৃমি সংক্রমণের আরও উপসর্গ আছে। যেমন: ওজন না বাড়া, পেট ফাঁপা, পেট কামড়ানো, আমাশয়, অপুষ্টি, রক্তশূন্যতা ইত্যাদি।
৪. গরমকালে কৃমিনাশক খাওয়া যাবে না—এমন ধারণারও কোনো ভিত্তি নেই। গরম, শীত, বর্ষা যেকোনো সময়ই কৃমিনাশক খাওয়া যাবে। তবে খাওয়ার পর বা ভরা পেটে খাওয়া ভালো।
৫. কৃমিনাশক নিরাপদ ওষুধ। এর তেমন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। তবে কারও কারও পেট ফাঁপা বা বমি ভাব হতে পারে। অনেক সময় কৃমিনাশক খেয়ে শিশুদের অসুস্থ হওয়ার যে খবর পাওয়া যায়, তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অজ্ঞতা ও কুসংস্কারজনিত।
৬. পানি অবশ্যই ফুটিয়ে বা বিশুদ্ধ করে পান করবেন। শাকসবজি ও মাংস খাওয়ার আগে ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। খাবার প্রস্তুত ও পরিবেশনের আগে ভালো করে হাত ধুতে হবে। শিশুদের খাওয়ার আগে ও শৌচাগার ব্যবহারের পর সাবান দিয়ে কীভাবে ভালো করে হাত কচলে ধুতে হয়, তা শেখানো জরুরি।
৭. বাইরের খোলা অপরিচ্ছন্ন খাবার না খাওয়াই ভালো। মাঠঘাটে শিশুদের খালি পায়ে খেলতে দেবেন না।
৮. কেবল গ্রামে বা রাস্তায় থাকা শিশুদের কৃমি হয়—এই ধারণাও ভুল। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যে-কারও কৃমি সংক্রমণ হতে পারে। তাই অপুষ্টি এড়াতে নিয়মিত কৃমিনাশক খাওয়াই ভালো।
কৃমি থেকে বাঁচার উপায়:
কৃমি বেশ জটিল একটি সমস্যা। বড় থেকে ছোট সবাই এই সমস্যায় ভোগে। তবে শিশুদের বেশি ভুগতে দেখা যায়। তবে একটু সচেতন হলে কৃমি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এ জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
১. খাওয়ার আগে ও টয়লেট থেকে আসার পর সাবান (লিকুইড সোপ হলে ভালো) দিয়ে হাত ধুতে হবে।
২. শিশুদের হাত ও পায়ের নখ ছোট রাখতে হবে।
৩. ছোট শিশুদের মলমূত্র অন্যত্র ফেলে না রেখে তা উঠিয়ে কমোডে ফেলতে হবে।
৪. শিশুদের মলমূত্রেও জীবাণু থাকে। তাই এদের মলমূত্র পরিষ্কারের পরও সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে।
৫. রান্নার আগে শাকসবজি ও অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী ভালোভাবে ধুতে হবে। এ সময় অবশ্যই হাত ধুতে হবে।
৬. রান্নার পাতিল, থালা-বাসন নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে।
৭. খাবারে যাতে মাছি বসতে না পারে, সে জন্য সব সময় ঢেকে রাখতে হবে।
৮. মাংস, বিশেষ করে গরুর মাংস পুরোপুরি সেদ্ধ করতে হবে।
৯. টয়লেটে যাওয়ার সময় অবশ্যই শিশুদের স্যান্ডেল পরানোর অভ্যাস করতে হবে।
১০. গৃহপালিত কুকুর ও বিড়ালকে নিয়মিত কৃমিনাশক ওষুধ দিতে হবে।
১১. দুই বছর বয়সের পর প্রত্যেক শিশুকে ছয় মাস অন্তর নিয়মিত কৃমির ট্যাবলেট খাওয়াতে হবে।
শিশুরা এমনিতেই পর্যাপ্ত খাবার খায় না। তাই গৃহীত খাদ্যের একটা অংশ কৃমির কারণে অপচয় হলে তা শিশুদের তীব্র স্বাস্থ্যহানি ঘটায়। সুতরাং শিশুরা যেন কৃমির কারণে অপুষ্টিতে না ভোগে, সে লক্ষ্যে মা-বাবাকে হতে হবে আরো সচেতন।