বাংলার শিক্ষক সকলকে বলেছিলেন, নিজের মন থেকে একটা গল্প লিখে নিয়ে এসো। ১৫ বছরের মেয়েটি লিখল তার জীবনের গল্প। লিখল, ন’বছর আগে যে দিন মা তাকে কোলে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসেন, সে দিন তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল।
লিখল, বাবা তাকে খুব ভালবাসে, কিন্তু সে কোনও দিন সেই ভালবাসার স্বাদ পায়নি। মেয়েটির সেই ‘গল্প’ নাড়িয়ে দিয়েছে স্কুলের শিক্ষকদের। তাঁরা এখন চাইছেন, মিলে যাক বিচ্ছিন্ন হওয়া এক পরিবারের দুই অংশ, যাতে মেয়েটি ফিরে পায় তার হারিয়ে যাওয়া জীবন।
বৃহস্পতিবার জলপাইগুড়ির গড়ালবাড়ি হাইস্কুলে বসে প্রধান শিক্ষক অভিজিৎ ঘোষ মেয়েটির খাতা পড়ে শোনাচ্ছিলেন, ‘‘আমার বাবা আমাকে খুব ভালবাসে। বাবা আমাকে ওখানে (বাবার কাছে) নিয়ে গেলে কোনও অভাব রাখবে না। কিন্তু আমি যাব না। আমি জানি না, বাবার ভালবাসা কাকে বলে। কারণ কোনও দিনও বাবার ভালবাসা পাইনি।’’ সে লিখেছে, অনেক ছোটবেলায় এক বার বাবা নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু খুব কান্নাকাটি করায় ফিরিয়ে দিয়ে গিয়েছেন মায়ের কাছে। লিখেছে, ‘‘আমার ইচ্ছে, বাবা-মা-ভাইবোন মিলে একসঙ্গে থাকি। কিন্তু সেটা তো কোনও দিনও সম্ভব নয়।’’
গল্পের শেষে শিক্ষককে ছাত্রী লিখেছে, “স্যর, আমার মনের এই কথা কোনও দিন কাউকে বলিনি। কাউকে যে প্রকাশ করব, এমনটা ভাবিওনি। আপনাকে সব জানালাম। সব কিছু বলতে পেরে আমার খুব হালকা লাগছে।” লেখাটা শুনতে শুনতে বাংলার শিক্ষক বিপ্লব পাত্রের চোখের কোণ চিকচিক করছে। তিনি বললেন, “সবাইকে স্বরচিত গল্প লিখে আনতে বলেছিলাম। ওই মেয়েটি নিজের জীবনের গল্পই লিখে এনেছে।”
শিক্ষকেরা বলছিলেন, ছাত্রীটি ক্লাসে কারও সঙ্গেই বেশি কথা বলে না। উদাস হয়ে বসে থাকে। তবে পড়াশোনায় মনোযোগী। তাঁদের কথায়, পারিবারিক অশান্তি কী ভাবে শিশু মনে প্রভাব ফেলে, এই ঘটনা তার উদাহরণ। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ স্বস্তিশোভন চৌধুরী বলেন, “ছাত্রীটির মানসিক পরিস্থিতি বিপজ্জনক। এটা দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকলে ওর মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার বোধ প্রবল হবে। ভবিষ্যতে ওর নিজের সম্পর্কগুলির ক্ষেত্রেও তার প্রভাব পড়বে।”
লেখাটি পড়ার পরে তাই আর দেরি করেননি স্কুল কর্তৃপক্ষ। স্কুলের কাছেই একটি গ্রামে ছাত্রীর দাদুর বাড়ি। সেখানে খবর দিয়ে ডেকে পাঠানো হয়েছে তার মা ও দাদুকে। তাঁরাও জানিয়েছেন, নিজেদের বক্তব্য স্কুলকে জানাবেন।
ছাত্রীর বাবার ঠিকানাও খুঁজে বার করছে স্কুল। ডেকে পাঠানো হবে তাঁকেও। প্রধান শিক্ষক বলেন, “প্রতিটি পড়ুয়ার ব্যক্তিজীবন থাকবে, অভিভাবকেরাও থাকবেন। তবে শিক্ষকেরাও তাদের অভিভাবক। কোনও পড়ুয়া কষ্টে রয়েছে জানলে স্কুল হাত গুটিয়ে থাকতে পারে না!’’