কাল সারারাত আমা’র জামাই আমা’র পা টিপে দিছে ভাবী! পায়ের ব্য’থায় ঘুমোতে পারছিলাম না। –আরে ভাবী আমি অসু’স্থ থাকলে তো আমা’র জামাই আমা’র ছায়া-ব্লাউজ পর্যন্ত ধুয়ে দেয়। বলেই একজন আরেকজনের গায়ে হেসে লুটিয়ে পড়ছে।
প্রতিদিন বিকেলে ‘তানহা’কে নিয়ে কোচিং এ আসার পর প্রায় প্রত্যেক ভাবীদের এসব অসহ্যকর কথা শুনতে হয় আমাকে।জুইয়ের আম্মু হ’ঠাৎ পিছন থেকে ধা’ক্কা দিয়ে বলে উঠে, -কি হলো তানহা’র মা, এতো চুপ’চা’প কেনো?তুমিও কিছু বলো তোমা’র জামাইয়ের কথা!
আমি এক দীর্ঘশ্বা’স ছে’ড়ে উত্তর দেই, -আমা’র তো বলার মতো কিছু নেই ভাবী,প্রতি ২ কিংবা ৩ বছর বাদে একবার দেখা পাই আমি তানহা’র আব্বুর।বাবা-মা যখন থেকে প্রবাসী স্বামীর কাছে বিয়ে দিয়েছে ‘তীর্থের কাকের’ মতো চেয়ে থাকি,কবে আবার তার দেখা পাবো? জুইয়ের মাঃ তোমা’রই তো শান্তি, চাইলেই দেশে বসে ৮/১০ টা প্রেম ক’রতে পারো,জামাই টের ও পাবেনা।আমা’র জামাই তো খালি সন্দে’হ করে আমাকে। -কি বলেন ভাবী?জামাই থাকতে প্রেম কেনো করবো?
জুইয়ের মাঃ এতো সুন্দর তুমি,বয়স ও কম।ক্যামনে থাকো জামাই ছাড়া?নিজে’র রুপ-যৌ’বন এইভাবে ন’ষ্ট করিওনা।তোমা’র জামাই বিদেশে কতো জনের সাথে ঘুমায় তা কি তোমা’রে বলে? -না জে’নে মন্তব্য করা কি ঠিক ভাবী?
যদি তিনি পাপ করে তার কৈফত তিনি আল্লাহ্র কাছে দেবে।আমি কেনো পাপের বোঝা মাথায় নেবো। জুইয়ের মাঃ শোন! এই পাপ-পূন্যের ভাত নেই আজকাল। শ্বশুর বাড়ির মানুষ কোনদিন আপন হয় না।নিজে ব্যাংক-ব্যালেন্স করো।জমি-জমা কেনো,নাহলে যখন শুনবা জামাই আরেকটা বিয়া করছে তখন আমা’র কথা মনে কইর্যা পস্তাবা। আমি আর জুইয়ের মা’র কথায় কান দিলাম না।
তানহা’র বয়স যখন ৩ বছর তখন শেষ এসেছিলো তানহা’র আব্বু।এখন তানহা’র বয়স ৫ বছর চলছে।বিয়ের পর থেকে ৬ বছরে ৩ বার এসেছেন তিনি।তাও প্রত্যেকবার ৩/৪ মাসের বেশী থাকেন নি।প্রত্যেকবার যখন তিনি আসেন আমা’র মনে হয় আমাদের নতুন বিয়ে হয়েছে,খুব অচেনা লাগে মানুষটাকে,তবে তিনি মানুষ হিসেবে খা’রাপ না।দেশে থাকলে অন্য ভাবীদের বরদের মতোই আমা’র খেয়াল রাখতো।
বিয়ের আগে যে আমি প্রেম করিনি তা কিন্তু নয়,সত্যি বলতে লজ্জা নেই,কলেজ লাইফে একটা ছেলেকে খুব ভালোবাসতাম,কিন্তু সেইম এইজ এর রিলেশনে যা হয় আর কি?বিয়ে আর হয়নি।আহারে! ছেলেটা আমা’র বিয়ের দিন ঘুমের ঔষধ খেয়ে হাসপাতালে ছিলো,কিন্ত কিছুই করার ছিলোনা আমা’র।এখন মাঝে মাঝে স্কুল আর কলেজে’র সেই ব’ন্ধু-বান্ধবীদের সাথে স্মৃ’তিময় দিনগুলোর কথা ভাবি। স্মৃ’তিগুলো খুব আঘা’ত করে আমাকে,ফি’রে যেতে ইচ্ছে হয় ছেলেবেলায়।
‘তানহা’ আমা’র একমাত্র মেয়ে।তানহা’র আব্বুর এখন একটা ছেলের সখ।আমা’র জীবন অনেকটা রুপকথার রাজা-রানীর মতো,”অবশেষে তারা সুখে-শান্তিতে বসবাস ক’রতে লাগলো”এরকম। তাই পরেরবার একটা ছেলে হলে বাচ্চা নেয়ার ঝামেলা থেকে বেঁ’চে যাই। কেনোনা অন্যান্য ভাবীদের মতো আমা’র অসু’স্থ অব’স্থায় খেয়াল নেয়ার মতো কেউ থাকেনা।নিজে’র ঔষধ নিজে’র কিনে খেতে হয়,নিজে’র সংসারের রান্নার বাজার নিজে’র ক’রতে হয়।তার উপরে শাশুড়ি, ননদিনী কিংবা শ্বশুর বাড়ির অন্যান্য আত্নীয়-স্বজনদের মন জোগিয়ে চলতে হয়।
বছর এর বছর এভাবেই সন্তান লালনপা’লন আর পরিবারের দেখাশুনা করেই কে’টে যায় আমাদের মতো প্রবাসী স্বামীর স্ত্রীদের।দিনশেষে ভালোবেসে ‘ভালোবাসি’ বলার মতো মানুষটা পাশে থাকেনা।মুখে তুলে একবারের জন্যও অন্যান্য ভাবীদের বরের মতো কেউ খাইয়ে দেয়না কিংবা ঈদ-কুরবানীতে কেউ শপিংমলে নিয়ে যেয়ে নিজে’র পছন্দের শাড়ি-চুড়ি কিনে দেয়না।আমা’র’তো আগে শাশুড়ি আর ননদের জন্য কিনতে হয়।সবশেষে তানহা’র জন্য কেনাকাটা করে নিজে’র জন্য কিছু কেনার ইচ্ছেটা কেনো জানি মরে যায়।
টাকা-পয়সার অভাব নেই আমা’র প্রবাসী স্বামীর।কিন্তু এসবের মাঝে শান্তি খুঁজে পাইনা আমি। এতো প্রতিক্ষার পর যখন একবার স্বামী বিদেশ থেকে ফি’রে তখন তিনি শ্বশুর বাড়ির আত্নীয়-স্বজন নিয়ে এতোই ব্যস্ত থাকে যে আমাকে আর সময় দিতে পারেনা।
যে কয়টা দিন দেশে থাকে দিন শেষে রাত্রের সময়টুকু তাকে কাছে পাই,তখন মনে হয় আমা’র আর তার স’স্পর্ক শুধু বি’ছানার মাঝেই সীমাবদ্ধ। তবে আমি তানহা’র বাবার দোষ দিচ্ছি না।তাকেও তো আত্নীয়-স্বজন এর মন জোগিয়ে চলতে হয়। নাহলে গুরুজনদের কটু কথা শুনতে হবে,”এতোদিন পর দেশে এসে বউয়ের আঁচলের নিচে রইলো”
ননদ আর ভাশুরের ছেলেমেয়েরা ব্যস্ত থাকে তাদের মামা কিংবা চাচা বিদেশ থেকে কি এনেছে তাই নিয়ে।কোনটা আনতে বলে আনা হলোনা,কে কোনটা পায়নি সেই অ’ভিযোগ নিয়ে।মাঝে মাঝে অনেক অ’ভিযোগের বোঝা আমা’র মাথায় ও পরে,”আমি নাকি বিদেশি জিনিস বাপের বাড়ি নিয়ে যাই”।বিয়ের আগে তিনি নাকি এমন ছিলেন না।তবে আমি তো জানি আমা’র আর তার স’স্পর্ক কতোটা ফরমাল।
শেষবার যখন তানহা’র আব্বু এসেছিলো সামান্য কিছু বিদেশি চকলেট আমা’র বোনের ছেলেমেয়েদের দেয়ায় আমা’র শাশুড়ি আমাকে অকথ্য ভাষায় অপমান করে।সেদিন খুব কেঁদেছিলাম আমি,মুখ বুঝে সংসার টিকিয়ে রাখতে সবকিছু সহ্য ক’রতে হয় আমাদের মতো নারীর। আমাদের মতো বিবেকবান মেয়েরা আর যাই পারুক সংসার ভাঙতে পারেনা।
আমা’র উচ্চস্বরে হাসতে নেই আবার পরপুরুষের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলতে নেই।তাহলেই যে মানুষ কথা তুলবে “তানহা’র মা’র স্বামী বিদেশে থাকে আর সে অন্য পুরুষের সাথে হাসাহাসি করে”।এইসব অপবাদ যে কতটা য’ন্ত্রণাদায়ক বুঝি আমি।আমাদের মতো প্রবাসী স্বামীর স্ত্রী’দের কান্না শুধু রাতের বালিশের মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখতে হয়।
ভাবতে ভাবতে তানহা’র কোচিং ছুটি হয়ে যায়। এখন বাসায় ফেরার পথে বাজার আর শাশুড়ির ঔষধ নিতে হবে।রাতের রান্না করে তানহা’কে পড়াতে হবে। তারপর বাসার প্রয়োজন বুঝিয়ে দিয়ে একবার যদি তানহা’র আব্বুর ফোন পাই।তারপর আবার সকাল,ফজরের নামাজে’র পর সবার জন্য নাস্তা বানিয়ে তানহা’কে নিয়ে স্কুলে আসবো। আবার বিকেল হবে,ভাবীদের গল্প শুনবো কোচিং এ এসে।তারপর আবার রাত হবে,চোখের অশ্রু ও ফুরিয়ে যাবে।একদিন বুড়ি হয়ে যাবো,কিন্তু আমা’র গল্প সবার অজা’নাই থেকে যাবে।