বেসরকারি এক টেলিভিশনে অনুষ্ঠিত ধর্মবিষয়ক এক অনুষ্ঠানের উন্মুক্ত প্রশ্নত্তোর পর্বে এক দর্শক প্রশ্ন করেন মেয়েদের জান্নাত কি মায়ের পায়ের নীচে না স্বামীর পায়ের নীচে?
আর এ প্রশ্নের উত্তরে হজরত মাওলানা মুফতী কাজী মুহম্মদ ইব্রাহীম বলেন, ‘স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত আর মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত- এই দুইটির কোনোটাই সহীহ হাদীসে নেই’। তবে এর ভাবটা সহীহ হাদিসে আরেকভাবে এসেছে, যেমন স্ত্রীর ব্যাপারে বলা হয়েছে, তোমার স্বামী তোমার জান্নাত অথবা জাহান্নাম। তাকে যদি সন্তুষ্ট করতে পারো জান্নাত, আর সে যদি ন্যায্যভাবে অসন্তুষ্ট থাকে তাহলে তোমার জন্য জাহান্নামের কারণ হবে। ঠিক মাতাপিতার ব্যাপারেও বলা আছে হাদিসে। মাতাপিতা হলো সন্তানের জন্য জান্নাতের গেইট। তবে প্রচলিত যে কথাটা আছে মায়ের পায়ের নিচে অথবা স্বামীর পায়ের নিচে বেহেশত এটা কোনও সহীহ হাদিসে নেই।
প্রসঙ্গত, ‘স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত।’ এটি সমাজে প্রচলিত অন্যতম একটি ভুল উক্তি। মারাত্মক বিষয় হলো- এ কথাকে হাদিস হিসেবে চালিয়ে দেওয়া। ইসলামি শরিয়ত এমন কথাকে সমর্থন করে না। এমন উক্তির কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। এটা কারা আবিষ্কার করেছে, তাও অজানা।
অনেক বক্তা কিংবা আলোচক স্ত্রীর প্রতি স্বামীর হক বা স্বামীর আনুগত্য বিষয়ে কথা বলতে যেয়ে ওপরের কথাকে হাদিস হিসেবে পেশ করে থাকেন। কিন্তু এমন শব্দ বা বাক্যে কোনো হাদিসে পাওয়া যায় না। সুতরাং এটাকে হাদিস হিসেবে বলা যাবে না।
তবে হ্যাঁ, অনেক হাদিসে স্ত্রীর জন্য স্বামীর আনুগত্য জরুরি। এ বিষয়ক বর্ণনা পাওয়া যায়। মুয়াত্তা মালেক, মুসনাদে আহমাদ, মুসতাদরাকে হাকেমসহ হাদিসের বেশ কিছু কিতাবে বর্ণিত হয়েছে, একবার এক নারী সাহাবি রাসূলের (সা.) কাছে এলেন নিজের কোনো প্রয়োজনে। যাওয়ার সময় হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কি স্বামী আছে? তিনি বললেন, জ্বী, আছে। নবীজী (সা.) বললেন, তার সঙ্গে তোমার আচরণ কেমন? সে বলল, আমি যথাসাধ্য তার সঙ্গে ভালো আচরণ করার চেষ্টা করি। তখন নবীজী (সা.) বললেন, হ্যাঁ, তার সঙ্গে তোমার আচরণের বিষয়ে সজাগ থেকো, কারণ সে তোমার জান্নাত বা তোমার জাহান্নাম। -মুয়াত্তা মালেক: ৯৫২; মুসনাদে আহমাদ: ৪/৩৪১
স্বামী-স্ত্রীর একের ওপর অন্যের প্রচুর হক রয়েছে। এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালা কোরআনে কারিমে মৌলিক নির্দেশনাও প্রদান করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর স্বামীদের যেমন তাদের (স্ত্রীদের) ওপর ন্যায়সঙ্গত হক রয়েছে, তেমনি তাদেরও হক রয়েছে স্বামীদের ওপর।’ -সূরা আল বাকারা: ২২৯
ইসলামিক পরিভাষা অনুযায়ী, পার্থিব জীবনে যে সকল মুসলিম আল্লাহর আদেশ নিষেধ মেনে চলবে এবং পরকালীন হিসাবে যার পাপের চেয়ে পুণ্যের পাল্লা ভারী হবে ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করবে তাদের জন্য আল্লাহ যে সকল স্বর্গ প্রস্তুত রেখেছেন। এটি একটি আরবি শব্দ, যার শাব্দিক অর্থ হল “বাগান” বা “উদ্যান”| প্রচলিত বাংলা ভাষায় একে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বেহেশত বলা হয়ে থাকে।
জান্নাতের প্রশস্ততা সম্পর্কে কুরআনুল কারীমে আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, তোমরা দ্রুত অগ্রসর হও তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমার দিকে ও সেই জান্নাতের দিকে যার বিস্তৃতি হচ্ছে আসমানসমূহ ও যমীনের সমান, যা মুত্তাকীদের জন্য তৈরী করা হয়েছে। (সূরা আল ইমরান- ১৩৩)
জান্নাত দেখার পরই সঠিকভাবে বোঝা যাবে যে জান্নাত কত বিশাল এবং তার নেয়ামত কত অসংখ্য। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, তুমি যখন দেখবে তখন দেখতে পাবে ভোগ বিলাসের নানান সামগ্রী আর এক বিশাল রাজ্য। (সূরাহ আদ্-দাহ্রঃ ২০)
জান্নাতে শত স্তর আছে আর প্রত্যেক স্তরের মাঝে এত দূরত্ব আছে যতটা দূরত্ব আছে আকাশ ও যমিনের মাঝে। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘জান্নাতে শত স্তর আছে। প্রত্যেক স্তরের মাঝে দূরত্ব হল আকাশ ও যমীনের দূরত্বের সমান। আর ফেরদাউস তার মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরে আছে। আর সেখান থেকেই জান্নাতের চারটি ঝর্ণা প্রবাহমান। এর উপরে রয়েছে আরশ। তোমরা আল্লাহ্র নিকট জান্নাতের জন্য দু’আ করলে জান্নাতুল ফেরদাউসের জন্য দু’আ করবে’। (তিরমিজী- কিতাবুল জান্নাহ)
জান্নাতে একটি বৃক্ষের ছায়া এত লম্বা হবে যে কোন অশ্বারোহী ঐ ছায়ায় শত বছর পর্যন্ত চলতে পারবে। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘জান্নাতে এমন একটি বৃক্ষ আছে যার ছায়ায় কোন আরোহী শত বছর পর্যন্ত চলতে পারবে। আর তোমরা ইচ্ছা করলে তিলাওয়াত করতে পার ‘এবং দীর্ঘ ছায়া”। আর জান্নাতে তোমাদের কারও একটি ধনুকের পরিমাণ জায়গাও ঐ জায়গা অপেক্ষা উত্তম যেখানে সূর্য উদিত হয় আর সূর্য অস্তমিত হয় (অর্থাৎ পৃথিবীর চেয়ে)”। (সহীহ বুখারী, হাদীস সংখ্যা- ৩২৫২, ৩২৫৩)
সর্বশেষ জান্নাতে প্রবেশকারীকে এ দুনিয়ার চেয়ে দশগুণ বড় জান্নাত দান করা হবে। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন’, জাহান্নামে থেকে সবশেষে বের হয়ে আসা ব্যক্তিকে আমি চিনি। সে হামাগুড়ি দিয়ে জাহান্নাম থেকে বের হয়ে আসবে। তাকে বলা হবে, “যাও জান্নাতে প্রবেশ কর”। নবী সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “সে গিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে। সে দেখবে, লোকেরা স্ব স্ব স্থান অধিকার করে আছে। অতঃপর তাকে বলা হবে, “আচ্ছা সে যুগের (জাহান্নামের শাস্তি) কথা তোমার স্মরণ আছে কি?” সে বলবে, “হ্যাঁ, মনে আছে”। তাকে বলা হবে, “তুমি কি পরিমাণ জায়গা চাও তা ইচ্ছা কর”। সে ইচ্ছা করবে। তখন তাকে বলা হবে, “তুমি যে পরিমাণ ইচ্ছা করেছো তা এবং দুনিয়ার দশগুণ জায়গা তোমাকে দেয়া হল”। একথা শুনে সে বলবে, “আপনি আমার সাথে ঠাট্টা করছেন? অথচ আপনি হলেন সর্ব শক্তিমান”। বর্ণনাকারী ইবনে মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন, “এ সময় আমি রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এমনভাবে হাসতে দেখেছি যে, তাঁর মাড়ির দাঁত পর্যন্ত প্রকাশ হয়ে পড়েছে’। (সহীহ মুসলিম – কিতাবুল ঈমান)
জান্নাতে সর্বশেষ ব্যক্তি প্রবেশ করার পরও অনেক জায়গা বাকী থাকবে যা পূর্ণ করার জন্য আল্লাহ্ তা’আলা নতুন জীব সৃষ্টি করবেন। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন’, জান্নাতে যতটুকু স্থান আল্লাহ্ চাইবেন ততটুকু স্থান খালি থেকে যাবে। অতঃপর আল্লাহ্ তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী অন্য এক জীব সৃষ্টি করবেন’। (সহীহ মুসলিম – কিতাবুল জান্নাহ)।
তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট ও উইকিপিডিয়া