শুরুতেই একটু পিছনে ফিরে দেখা যাক। আজ থেকে ৪০ বছর আগে পর্যন্ত, অর্থাৎ মা-কাকিমাদের আমলে, মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে কন্যাসন্তান জন্মালে ধরে নেওয়া হত, সে পরের বাড়ি ঘর করবে। ফলত, ছোটো থেকেই শুরু হত ঘরকন্যার প্রশিক্ষণ। লেখাপড়া শেখানো হত, যাতে সে পরবর্তী সময়ে ভালোভাবে সংসার করতে পারে। ছেলেমেয়ে মানুষ করতে পারে। তাদের মধ্যেও কি ব্যতিক্রম ছিল না? ছিল। সে আমলেও অনেক মহিলা চাকরিবাকরি করতেন। তবে সংখ্যাটা খুব কম।
দিন যত এগোচ্ছে, চাকুরিরতাদের সংখ্যাও বাড়ছে হুহু করে। ভালো স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া, প্রোফেশনাল কোর্সে তালিম পেয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র, সাংবাদিকতা, আইন, বিজ্ঞাপন, সরকারি চাকরির জায়গায় উন্নতি করছে। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের তরফে মহিলাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। “বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও”, “কন্যাশ্রী”, পুরুষদের চেয়ে কম আয় করের ব্যবস্থা – সবই মহিলাদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য। যাতে তারা অন্ধকার থেকে বেরিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা পায়। নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। আর্থিকভাবে স্বাধীন হতে পারে।
সমাজের চিত্র পালটেছে বলে আজ অনেক মহিলাই স্বাধীন। বলা ভালো, আর্থিকভাবে স্বাধীন। অনেকেই পুরুষের সমতুল্য পদমর্যাদায় কর্মরত। কিন্তু সংসারে ঢোকার পর দেখা যায়, অনেকেই নিজের কর্মজীবন থেকে সরে আসে। বিশেষ করে সন্তান জন্মানোর পর, অনেকেই ছেড়ে দেয় চাকরি। সমঝোতা করে পরিস্থিতির সঙ্গে। আবার সন্তান একটু বড় হলে ফিরে যায় চাকরির দুনিয়ায়। কিন্তু সবাই কামব্যাক করতে পারে না। ৫-৬ বছরের ফারাকে অনেকসময় চাকরি পেতে সমস্যা হয়। নতুন করে কর্মজীবনে পদার্পণ করার ইচ্ছেই হারিয়ে ফেলে। এতশত ভেবে, বর্তমান প্রজন্মের নারীরা বিয়ে-সংসারের মতো শর্তে রাজি হতে চায় না। নিজের পরিচয় ত্যাগ করতে চায় না। কিন্তু কিছু বিষয়ে ভারসাম্য বজায় রাখলে অতিসহজেই চাকরি ও সংসারে নিজের ভূমিকা বজায় রাখা সম্ভব। এতে মন-মানসিকতা ভালো থাকে। কেননা, Empty mind is a devil’s workshop – (অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা)।
বিয়ের পর চাকরি করার প্লাস পয়েন্ট –
১] স্বামী-স্ত্রী চাকরি করলে জীবনযাত্রার মান বাড়ে। আর্থিক অনটন থাকে না।
২] সংসারে অবদান থাকলে আত্মসম্মান বাড়ে বই কমে না।
৩] পরিবারের বাইরেও নিজস্ব একটা জগৎ তৈরি হয়।
৪] পরনিন্দা বা পরচর্চা করার স্বভাব তৈরি হয় না। যেটা অধিকাংশ গৃহবধূর অতিপ্রিয় স্বভাব।
বিয়ের পর চাকরি করার মাইনাস পয়ন্ট –
১] সারাক্ষণ কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে হয়। সংসার ও কর্মক্ষেত্র – দু’জায়গায় কাজের বোঝা সমস্যা তৈরি করে খুব।
২] পরিবারকে সময় দেওয়া যায় না। বিশেষ করে সন্তানকে সময় দেওয়া দায় হয়ে যায়।
৩] অনেকসময় স্বামীর জন্মদিন, পরিবারের কোনও শুভ অনুষ্ঠান, যেমন পুজো-পার্বণ, নিমন্ত্রিতদের অপ্যায়নে সময় ব্যয় করা যায় না।
৪] সময় না দেওয়ার কারণে স্বামীর সঙ্গে ঘনঘন মনমালিন্য হতে পারে।
৫] পরিবার ও চাকরি সামলাতে সামলাতে শরীর স্বাস্থ্য দুর্বল হয়ে যেতে পারে। অল্প বয়সে ডায়াবিটিজ়, হাই ব্লাড প্রেশার হতে পারে।
দু’দিকে ভারসাম্য বজায় রাখার টিপস্ –
১]সময় – বিয়ের পর চাকরি করতে আগ্রহী হলে দু’ভাবে সেটা করা যেতে পারে। এক, আপনি চাকরি বদলে নিলেন। এমন চাকরি বাছলেন, যেখানে নাইট শিফ্ট নেই, ১০টা থেকে ৭টার ডিউটি। শনি-রবিবার ছুটি। বা যে চাকরি করছেন, সেখানে কথা বলে ডিউটির সময় বদলে নেওয়া।
২]একই শহরে চাকরি – প্রেমিক/প্রেমিকা থাকাকালীন দু’জন দুটি ভিন্ন শহরে থেকে চাকরি করা সম্ভব। কিন্তু বিয়ের পর সেটা অনেকক্ষেত্রেই সম্ভব নয়। লং ডিসট্যান্স বিয়েতে সমস্যা আরও গভীর। ভুল বোঝাবুঝি, পারিবারিক অশান্তি চরমে উঠতে পারে।
৩]বাড়ি সাজান নিজে হাতে – ঘরের পরদা, বিছানার চাদর, দেওয়ালের রং নিয়ে উদাসীনতা দেখাবেন না। সবেতেই নিজের মতামত পোষণ করুন। বাড়ি সাজান নিজে হাতে। এতে পরিবারের প্রতি আপনার টান তৈরি হবে।
৪]পরিবারিক অনুষ্ঠান – সন্ধের সময় অফিস থেকে ফিরে স্নান সেরে, সাবেকি পোশাকে অনুষ্ঠানে যোগদান করুন। রান্না না করতে পারলেও নিজে হাতে সকলকে খাবার বেড়ে দিন, খাওয়ার টেবিলটা গুছিয়ে রাখুন সুন্দর করে। আমন্ত্রিতদের সঙ্গে গল্প করুন, ফোটো তুলুন, বড়দের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করুন। পুজোর অনুষ্ঠান হলে অবশ্যই শাড়ি পরুন।
৫]বাড়ির গিন্নি হয়ে উঠুন – ছুটির দিনে নিজে হাতে রান্না করুন ব্রেকফাস্ট ও লাঞ্চ। না হলে শ্বশুর-শাশুড়ি ও স্বামী-সন্তানের সঙ্গে বাইরে বেড়াতে যান। সিনেমা দেখতে যান স্বামী-স্ত্রীতে মিলে। আর রাতের ডিনারটা সকলে একসঙ্গে খান।
৬]বাড়িতে অফিস নয় – বাড়ি ফিরে অফিসের কাজ নিয়ে বসবেন না। অফিসের কাজকে অফিসেই ছেড়ে আসুন। না হলে পরিবার খুব অবহেলিত হবে।
৭]সন্তান – বিয়ের পর চাকরি করা অসুবিধে হয় সন্তান ছোটো থাকলে। এমনকী, মাতৃত্বকালীন বা ম্যাটারনিটি লিভের মেয়াদ ফুরিয়ে গেলেও সন্তানকে সময় দিতে হয়। তাই এই সময়টায় মহিলারা চাকরি ছেড়ে দেন। চাকরি না ছেড়েও সন্তান মানুষ করা সম্ভব। এর জন্য সন্তানকে আগে থেকেই পরিস্থিতির সঙ্গে ধাতস্থ হতে দিন, যাতে সে আপনাকে ছেড়ে অন্তত ৮ ঘণ্টা থাকতে পারে। যেমন – প্রথমে ১ ঘণ্টা সন্তানকে ছেড়ে থাকুন। তাকে বুঝতে দিন আপনি আশপাশে নেই। তারপরের দিন ২ ঘণ্টা… ধীরে ধীরে টানা ৮ ঘণ্টা সন্তানকে ছেড়ে সময় কাটান। দিনের কিছুটা সময় সন্তান আপনাকে ছাড়াই থাকতে পারবে। শুধু তাই নয়, সন্তানের সঙ্গে সময় কাটানোটাও দরকার। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে সন্তানকে সময় দিন। তাকে লেখাপড়ায় সাহায্য করুন। তার মনের কথা শুনুন। সন্তান যাতে আপনাকে কোনওদিনও ভুল না বোঝে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত করুন নিজেকে। মেয়েদের চাকরি করা খারাপ নয়, সেটা তাকে ছোটো থেকেই উপলব্ধি করতে দিন।