আজ থেকে ৮৬ বছর আগে কোরআনের ধ্বনি গুঞ্জরিত হতে শুরু করে মসজিদটিতে। সেই ধ্বনি আর বিশ্রাম নেয়নি ক্ষণিকের জন্যও। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, ১৯২৯ সাল থেকে এই মসজিদে ২৪ ঘণ্টা কোরআন তেলাওয়াত করার রীতি হয়েছে। মসজিদের বাহ্যিক ও অভ্যান্তরীণ কাঠমোর পরিবর্তন হলেও এই রীতি লঙ্ঘন হয়নি ৮৬ বছরে এক মিনিটের জন্যেও। বর্তমানে এই মসজিদে সাতজন ক্বারি নিযুক্ত রয়েছেন। ২ ঘণ্টা পর পর একেকজন কোরআন তেলাওয়াত করে থাকেন।
ধনবাড়ী নবাব প্যালেসটি অবস্থিত টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে। খান বাহাদুর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ছিলেন ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার প্রথম প্রস্তাবক এবং ব্রিটিশ সরকারের প্রথম মুসলিম মন্ত্রী। তাঁরই অমর কৃর্তি ধনবাড়ী জমিদার বাড়ি বা নওয়াব প্যালেস।
বংশাই ও বৈরান নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত এই প্রাচীন জমিদারবাড়িটি অপূর্ব স্থাপত্যশৈলী এবং কারুকার্যে সত্যিই মনোরম এবং মনোমুগ্ধকর। তবে রিসোর্ট তৈরির পর নবাব প্যালেসে বেড়েছে চাকচিক্য এবং আধুনিকতা। চার গম্বুজবিশিষ্ট অপূর্ব মোগল স্থাপত্যরীতিতে তৈরি এই শতাব্দীপ্রাচীন নবাব প্যালেস। পুরো নবাব মঞ্জিল বা নবাব প্যালেসটি প্রাচীরে ঘেরা। প্রাসাদটি দক্ষিণমুখী এবং দীর্ঘ বারান্দাসংবলিত। ভবনের পূর্বদিকে বড় একটি তোরণ রয়েছে। তোরণের দুই পাশে প্রহরীদের জন্য রয়েছে দুটি কক্ষ। তোরণটি জমিদার নওয়াব আলী চৌধুরী ব্রিটিশ গভর্নরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য নির্মাণ করেন। প্রাচীরঘেরা চত্বর অংশে আবাসিক ভবন দুটি ছাড়া আরো আছে ফুলের বাগান, চিড়িয়াখানা, বৈঠকখানা, নায়েবঘর, কাচারিঘর, পাইকপেয়াদা বসতি এবং দাস-দাসি চত্বর; যা এখনো আপনি দেখতে পাবেন।
দর্শনার্থীদের জন্য প্রাসাদের ভেতরের বেশ কয়েকটি কামরা ঘুরে দেখার সুযোগ আছে। তা ছাড়া বারান্দাতেও শোভা পাচ্ছে মোগল আমলের নবাবি সামগ্রী, সেগুলো ছুঁয়ে দেখতে পারেন। মোগল আমলের আসবাবপত্র আপনাকে মুগ্ধ করবে। প্যালেসটির পাশেই রয়েছে ৩০ বিঘার বিশালাকার দিঘি, যার কূলকিনারা খুঁজে পাওয়া দায়। সেখানে দর্শনার্থীদের ঘোরার জন্য রয়েছে দুটি সাম্পান, চড়তে পারেন আপনিও। তা ছাড়া নবাবি কায়দায় পুরো রিসোর্ট ঘুরে দেখার জন্য রয়েছে ঘোড়া ও ঘোড়ার গাড়ির ব্যবস্থা। ইচ্ছে হলে দেখতে পারেন গারোদের সংস্কৃতি ও নাচ। এ জন্য আপনাকে আগেই জানিয়ে রাখতে হবে রিসোর্ট কর্তৃপক্ষকে। তা ছাড়া এখানে আরো দেখতে পাবেন বিলুপ্তপ্রায় লাঠিখেলা।
রিসোর্টটির আরেকটি বিরাট আকর্ষণ নবাব মসজিদ। রয়েল রিসোর্টের ঠিক পাশেই রয়েছে ৭০০ বছরের পুরোনো এক মসজিদ। মোগল স্থাপত্যের নিদর্শন এই মসজিদের মোজাইকগুলো এবং মেঝেতে মার্বেল পাথরে নিপুণ কারুকার্য অসাধারণ। মসজিদটির পাশে একটি কক্ষ রয়েছে, যা নবাব বাহাদুর সৈদয় নওয়াব আলী চৌধুরীর মাজার। ১৯২৯ সালে নবাবের মৃত্যুর পর থেকে এখানে ২৪ ঘণ্টা কোরআন তিলাওয়াত হচ্ছে, যা এখনো এক মিনিটের জন্য বন্ধ হয়নি। বর্তমানে সাতজন কারি নিযুক্ত রয়েছেন। তাঁরা প্রতি দুই ঘণ্টা পরপর একেকজন কোরআন তিলাওয়াত করে থাকেন।
মোগল স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত মসজিদটির আকার-অবয়বে বেশ কয়েকবার পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে। তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ লাগোয়া সুদৃশ্য ও জাঁকজমকপূর্ণ একটি মিনার রয়েছে। মসজিদকে কেন্দ্র করে মানত-প্রথা প্রচলিত রয়েছে। মসজিদটি প্রায় দশ কাঠা জমির ওপরে অবস্থিত। আদি মসজিদটি ছিল আয়তাকার। তখন এর দৈর্ঘ্য ছিল ১৩.৭২ মিটার (৪৫ ফুট) এবং প্রস্থ ছিল ৪.৫৭ মিটার (১৫ ফুট) কিন্তু সংস্কারের পর মসজিদটির আকার রীতিমতো পরিবর্তিত হয়ে যায়। বর্তমানে এটি একটি বর্গাকৃতির মসজিদ এবং সাধারণ তিনগম্বুজবিশিষ্ট আয়তাকৃতির মোগল মসজিদের সঙ্গে বৈসাদৃশ্যপূর্ণ। সংস্কারের পর বর্তমানে এর অনেক বৈশিষ্ট্যই ভিন্ন আঙ্গিক গ্রহণ করেছে এবং সেই সঙ্গে এর প্রাচীনত্ব লুপ্ত হয়েছে এবং চাকচিক্য অনেক বেড়েছে। সুন্দর কারুকার্যময় এ মসজিদের পূর্বদিকে বহু খাঁজবিশিষ্ট খিলানযুক্ত তিনটি প্রবেশপথ, এ ছাড়া উত্তর ও দক্ষিণে আরো একটি করে সর্বমোট পাঁচটি প্রবেশপথ রয়েছে। মসজিদটি বর্ধিতকরণ ও সংস্কার সাধনের পরেও এর ওপরের তিনটি গম্বুজ ও পাঁচটি প্রবেশপথে প্রাচীনত্বের ছাপ লক্ষ করা যায়।
প্রচলিত নিয়মে এ মসজিদের পূর্বদিকের তিনটি প্রবেশপথ বরাবর এর অভ্যন্তরে কিবলা দেয়ালে তিনটি মিহরাব নির্মিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় মিহরাবের কুলুঙ্গিটি অষ্টভুজাকার ও বহু খাঁজবিশিষ্ট খিলান সহযোগে ফুলের নকশায় অলংকৃত। উভয় পাশের দুটি ও বহু খাঁজবিশিষ্ট খিলানযোগে গঠিত তবে অলংকারহীন। কেন্দ্রীয় মিহরাবের পাশে একটি মিম্বার রয়েছে। মসজিদের অভ্যন্তরভাগ সর্বত্র চীনামাটির টুকরো দ্বারা মোজাইক নকশায় অলংকৃত, যার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফুলের নকশা লক্ষণীয়।
অর্ধবিঘা আয়তনের অনুচ্চ প্রাচীরবেষ্টিত একটি প্রাচীন কবরস্থান রয়েছে এখানে। আর এর পাশেই রয়েছে একটি মসজিদ। ধারণা করা হয় ইস্পিঞ্জার খাঁ ও মনোয়ার খাঁ মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ মসজিদে একসঙ্গে ২০০ জন মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। এখনো মসজিদ অভ্যন্তরে মোগল আমলের তিনটি ঝাড়বাতি শোভা পাচ্ছে। নওয়াব প্যালেস দর্শনে আপনিও হতে পারেন ঐতিহ্যের সাক্ষী। রিসোর্টের ভেতরে প্রবেশ করতে আপনাকে খরচ করতে হবে মাত্র ৩০ টাকা।
যেভাবে যাবেন –
মহাখালীর টাঙ্গাইল বাসস্ট্যান্ড থেকে ঢাকা-ধনবাড়ী সরাসরি বাস সার্ভিস চালু আছে। বিনিময়, মহানগর কিংবা শুভেচ্ছা পরিবহনে ১৫০-২০০ টাকা ভাড়ায় পৌঁছাতে পারবেন ধনবাড়ী। ধনবাড়ী বাসস্ট্যান্ড থেকে অদূরেই জমিদারবাড়ি, ইচ্ছে করলে হেঁটে কিংবা রিকশায় পৌঁছাতে পারেন সেখানে। বাসস্ট্যান্ড থেকে পায়ে হেটে ৫/৭ মিনিট লাগবে নবাব প্যালেস এ যেতে। আরোও ভাল হয় নিজস্ব পরিবহনে গেলে।