আপনি কতটা স্বাচ্ছন্দ্যে আছেন বা মাস শেষে কত বেশি পরিমাণ অর্থ আপনার ব্যাংক ব্যালেন্সে যোগ হচ্ছে তার কিছুতেই কিছু যায় আসে না, যদি না কর্মজীবনে আপনি যে কাজটিকে নিজের পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন তা থেকে মানসিক প্রশান্তি পেয়ে থাকেন। ঠিক এমনটাই ঘটেছিল ১৯৯৭ সালে ব্যাঙ্গালোর ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ করে বেরিয়ে বাবার স্টিলের ব্যবসায় যোগ দেয়া নাভাজ শরিফের সাথে। তার পৈতৃক ব্যবসা খুব ভালো চলছিল। অবশ্য শুধু ভালো বললে কম বলা হবে, আশাতীত রকমের ভালো করছিল। কিন্তু বেশ কিছুদিন ব্যবসায়ে মনোনিবেশ করে এবং নিজের সামর্থ্যের সবটুকু নিংড়ে দিয়েও শরিফ বুঝতে পারে, এই ব্যবসায়ে আসলে তার নতুন করে কোন অবদান রাখার সুযোগ নেই। আর সেজন্য ব্যবসার অবস্থা যতই ভালো হোক না কেন, সেটার মাধ্যমে খুব একটা মানসিক প্রশান্তি পাচ্ছিল না সে। মনের মধ্যে সবসময়ই কেমন একটা খুঁতখুঁতানি আর অতৃপ্তি থেকেই যাচ্ছিল। তাই একদিন সে ঠিক করল, এই ব্যবসায় আর নয়। তাকে নতুন কিছু করা শুরু করতে হবে। এবং শেষমেষ সেটাই করল সে।
ব্যক্তিজীবনে শরিফ খুবই ভোজনরসিক। বিশেষ করে বিরিয়ানি তার খুবই পছন্দের একটা খাবার। তাই তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বারবার তাকে জানান দিচ্ছিল, এই খাবারদাবারকে কেন্দ্র করেই কিছু একটা করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব তার পক্ষে। তবে অনেকটা সময় পর্যন্ত এটা স্রেফ চিন্তাভাবনার পর্যায়েই ছিল। এরপর একদিন বাসায় বসে মায়ের তৈরি বিরিয়ানি গলধকরণ করছিল সে। হঠাৎ করেই একটা নতুন ভাবনা তার মাথায় আসল। সেটা হলো, ভারতবর্ষ জুড়ে বিরিয়ানি খুবই জনপ্রিয় একটা খাবার। কিন্তু স্বাস্থ্যকরভাবে এটা পরিবেশন করে থাকে খুব কমসংখ্যক রেস্টুরেন্টই। আর এভাবেই স্বাস্থ্যকর বিরিয়ানি পরিবেশনের চিন্তা থেকেই সে ভেবে বের করল যে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বক্সে করে বিরিয়ানি বিক্রি করবে সে।
শরিফের দেয়া ব্যবসার নামটাও ছিল খুবই চমকপ্রদ- ‘আম্মিস বিরিয়ানি’। শুরুতে পরিবার-পরিজন ও বন্ধু-বান্ধব অনেকেই এই নাম নিয়ে তাদের আপত্তি জানিয়েছিল। কিন্তু শরিফের নিজের কাছে মনে হয়েছিল এই নামটাই পারবে সব ধরণের মানুষকে আকৃষ্ট করতে। এবং বাস্তবেও সেটাই হয়েছিল। সাধারণ মানুষ সাদরে গ্রহণ করে আম্মিস বিরিয়ানিকে, এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই শহরজুড়ে বেশ কয়েকটা আউটলেট খুলে ফেলতে সক্ষম হয় সে।
বর্তমানে ব্যাঙ্গালোরে শরিফের মোট ১৩টা বিরিয়ানির আউটলেট রয়েছে, পাশাপাশি যুগের সাথে তাল মিলিয়ে অনলাইনে অর্ডারের মাধ্যমে হোম ডেলিভারির ব্যবস্থাও রয়েছে। এবং শুধু বিরিয়ানি বিক্রি করেই সে ৪০ কোটি রুপির সম্পদ গড়ে তুলেছে। অনেকেরই বিশ্বাস, শরিফ চাইলেই এখন আম্মিস বিরিয়ানির কার্যক্রম পুরো ভারতে ছড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু শরিফ ‘ধীরে চলো’ নীতিতে বিশ্বাসী। আম্মিস বিরিয়ানি বর্তমানে ব্যাঙ্গালোরের একটা স্থানীয় ট্রেডমার্ক ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে, এবং সে অবশ্যই চায় এটা যেন গোটা দেশজুড়েই একটা জাতীয় ব্র্যান্ডে পরিণত হয়। কিন্তু তার আগে সে স্থানীয়ভাবে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত ও সুদৃঢ় করে তুলতে বেশি আগ্রহী।
এই মুহূর্তে ব্যবসায়ের পরিধি বাড়ানো নিয়ে শরিফ যে দোটানায় রয়েছে, সেটাকে বলা চলে এক ‘মধুর সমস্যা’। কিন্তু শুরুতে কেউ ভাবতেও পারেনি যে এমন দিনও আসবে শরিফের জীবনে। বাবার স্টিলের ব্যবসার মত নিরাপদ ক্যারিয়ারকে পায়ে ঠেলে দিয়ে সে যখন বিরিয়ানির ব্যবসা শুরু করল, তখন অনেকেই শরিফের ভবিষ্যৎ ঘোর অন্ধকার দেখেছিল। শরিফ নিজেও জানত না সে আসলেই সফলকাম হতে পারবে কিনা। কিন্তু তার মনে ছিল নতুন কিছু করার ইচ্ছা, যেখানে সে নিশ্চিন্ত ও স্বাচ্ছন্দ্য জীবন যাপনের চেয়ে নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারবে। পাশাপাশি সে এমন একটা ব্যবসা শুরু করেছিল যেটাকে সে নিজেও মন থেকে ভালোবাসত। আর এই দুইয়ের মিশেলেই সে আজ এতদূর আসতে সক্ষম হয়েছে।
শরিফের জীবনের গল্প তার একার নয়। তার মত অনেক শরিফই লুকিয়ে আছে আমাদের ভিতর, যারা হয়ত পেশা বা কর্মজীবনে অনেক স্বাচ্ছন্দ্যে আছে কিন্তু নিজেদের কাজ নিয়ে একদমই সন্তুষ্ট নয়। এভাবে ধীরে ধীরে সম্পদশালী হয়ে ওঠা যায় ঠিকই, কিন্তু প্রকৃত পরিতৃপ্তি লাভ কখনোই সম্ভব নয়। আর এজন্যই কর্মজীবনে সফল হয়েও অনেককেই দেখা যায় পুরো একটা জীবন অবসাদগ্রস্ত হয়ে কাটিয়ে দিতে। অথচ তারা যদি শরিফের মত একটু ঝুঁকি নিয়ে নিজেদের পছন্দের কাজ করতে আগ্রহী হয়, তবে দেরিতে হলেও তারা অবশ্যই সেখানে সাফল্যের দেখা পাবে।
তথ্যসূত্র- www.kenfolios.com