মাকে নিয়ে বাবা ও চাচা-চাচী দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে আতঙ্কে জীবনযাপন করছেন তিন বোন। মায়ের পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার জন্য নেশাগ্রস্থ বাবার দ্বারা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন দায়ী বলে দাবি তিন বোনের। বাবার এসব কাজের প্রতিবাদের ফলে মায়ের পর তাদের ওপরেও নেমে এসেছে নির্যাতন।
তিন মেয়ের অভিযোগ, সর্বশেষ পহেলা মে, তিন কিশোরী মেয়েকে মারধর করে বাসা থেকে বের করে দেয় বাবা ও চাচা। এর জন্য রাজধানীর চকবাজার থানায় ছুটে গেলে পুলিশের সহযোগিতায় তারা বাসায় ফিরে আসে। পরে, কেন তারা পুলিশের কাছে গেল এ নিয়ে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন বাবা ও চাচা। যার ফলে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছে তারা।
বাবা-চাচা-চাচির বিরুদ্ধে থানায় জিডি
নিজের বাবা ও চাচাদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়ে ওই তিন বোনের পক্ষে ৫ মে (শনিবার) চকবাজার থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন বড় বোন তাসনুভা হোসেন (১৭)। থানার জিডির নম্বর- ০৬।
জিডিতে তাসনুভা হোসেন উল্লেখ করেছেন, ‘আমিসহ আমার তিন বোন পিতা বিবাদী হাজী শাহেদ হোসেন (৫০), চাচা মো. রিয়াজ উদ্দিন (৪৫) ও চাচি মোছা. ফারজানা আক্তার জয়নাগ রোডের ৮/২ নাম্বার বাসায় থাকি। চাচা মো. রিয়াজ উদ্দিন ও চাচি মোছা. ফারজানা আক্তারের উপস্থিতে আমার পিতা আমার মাকে বিভিন্ন সময়ে নির্যাতন করে। আমার পিতার নির্যাতনে গত ১৬ জানুয়ারি আমার মা স্টোক (হার্ট এ্যাটাক) করে। স্টোক করার পরে বিবাদী ১নং (বাবা) চিকিৎসা না করে আরও নানাভাবে হয়রানি শুরু করে। এরই সূত্র ধরে গত ১ মে আনুমানিক বিকেল ৪টার সময়ে আমিসহ আমার দুই বোনকে বাসা থেকে বের করে দেয়। পরবর্তীতে বাসায় আসলে আমাদের প্রাণনাশের হুমকি প্রদান করে।’
জিডিতে তাসনুভা হোসেন আরও উল্লেখ করেন, ‘বর্তমানে আমাদের পিতা আমাদের স্কুলের খরচসহ অন্যান্য ভরণপোষণের খরচ বহন করছে না।’
রাত জেগে ছোট বোন ও মাকে পাহারা দেই
ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিন বোনের মধ্যে বড় মেয়ে তাসনুভা হোসেন প্রিয়.কমকে বলেন, ‘আমি নুর মোহাম্মদ কলেজে ইন্টামিডিয়েট প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করি। আমার ছোট বোন তাহসিন হোসেন ভিকারুন্নেসায় অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। আর সবার ছোট বোন তাসমিন হোসেন ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। আমাদের কোনো ভাই নেই।’
তাসনুভা আরও বলেন, ‘গত ১ মে বাবা আম্মুর ফোনে কল দিয়েছিল, কিন্তু আম্মুর ফোনটা সাইলেন্ট করা ছিল। আমরা কেউই ফোনের শব্দ শুনতে পাই নাই। আমরা তিন বোন মিলে আম্মুকে ভাত খাওয়াচ্ছিলাম। এই সময়ে বাবা খারাপ ভাষায় গালি দিতে দিতে রুমে ঢুকে।
আমার আম্মু কথা বলতে পারে না, তবুও আব্বুকে অ্যায় অ্যায় করে ঈশারায় ডাকছে। কিন্তু আব্বু এসে ভাত, তরকারি সব কিছুর মধ্যে পানি ঢেলে দেয়। তখন চাচা-চাচি আসে। এরপর আমাদের মারধর করে এই বলে যে, এগুলো তোরাই করছস। আর আমার আম্মু তখন কাঁদতেছিল।’
তাদেরকে ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয় জানিয়ে তাসনুভা বলেন, ‘এরপর আমাদের ঘর থেকে বের করে দেওয়া হলে আমরা থানায় যাই। থানা থেকে আমাদেরকে সাহায্য করা হয়। আর লাকি আপু নামের এক আপু আমাদেরকে একটা সংস্থার কাছে রাখে। ওই রাতে আমারা সেখানেই থাকি। এর পরের দিন পুলিশ নিয়ে বাসায় আসি। তারপর পুলিশ বাবা-চাচাকে বলে যায় যে ওদের আর মারতে পারবেন না।’
পুলিশের কাছে যাওয়ার পর মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তাসনুভা বলেন, ‘পুলিশ চলে যাবার পরেই তারা এলাকা থেকে বিভিন্ন গুণ্ডা এনে আমাদেরকে ভয় দেখায়। তোদেরকে মেরে ফেলব, মেয়ে হয়ে তোরা কেন পুলিশে, থানায় যাবি। মেয়েদের এত সাহস হয় না, মেয়েরা শুধুমাত্র রান্না-বান্না করবি।’
নিজেদের নিরাপত্তাহীনতার কথা জানিয়ে তাসনুভা বলেন, ‘এখন আমাদের জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই, ঘরের রুমের কোনো গেট নেই। এখন আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতেছি, এখন আমরা দুজন যদি রাতে ঘুমাই আর দুজন রাত জেগে পাহারা দেই। কখনো যদি কিছু হয় এই ভয়ে।’
‘বাবা জন্ম দিছে তোরা বাবার চাকর’
চাচা-চাচির প্রতি অভিযোগ জানিয়ে তাসনুভা বলেন, ‘যখন ঝামেলা হয় তখন তারা আমাদের মারে আর বলে তোরা বাবাকে রাগাবি কেন? বাবা জন্ম দিছে, তোরা বাবার চাকর, বাবা যেভাবে বলবে সেভাবেই তোদের চলতে হবে। এই বলে আমাদেরকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে। চুরি করলেও তোদের জন্যই করছে, যা করছে তোদের জন্য করছে। এজন্য যা ইচ্ছা তাই করতে পারবে। বাবা জন্ম দিছে, ঘর থেকে বেরও করে দিতে পারবে।’
বাবার এসব করার কারণ কী হতে পারে, জানতে চাইলে তাসনুভা হোসেন বলেন, ‘বাবা এখন কিছুই করেন না। আগে চুনের ব্যবসা করত। এখন বাবা নেশা করে আর টাকা ফুরায়। ওনি অনেক ধরনের ট্যাবলেট খায়। এই সব নিয়ে ঝামেলা করে। এখন আমাদের কোনো খরচ দিচ্ছে না।’
ম্যাইয়ারে কেউ কি বাসা থেকে বাইর করে দেয়
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে ওই তিন মেয়ের বাবা হাজী শাহেদ হোসেন প্রিয়.কমকে বলেন, ‘এই সব মিথ্যা। ম্যাইয়ারে কেউ কি বাসা থেকে বাইর করে দেয়, আপনি বলেন। পোলা হইলে তাও একটা কথা ছিল।’
মারধর করেছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, ওরা মায়ের অযত্ন করেছিল তাই একটু বকাবকি করেছি।’
এই বিষয়ে জানতে ওই তিন বোনের চাচা মো. রিয়াজ উদ্দিনের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও কলটি রিসিভ হয়নি।
পুলিশের ভাষ্য ‘ডাকলেই হাজির হব’
ওই তিনবোনের দায়ের করা জিডির তদন্তকারী কর্মকর্তা চকবাজার থানার উপপরিদর্শক (এসআই) দেলোয়ার হোসেন প্রিয়.কমকে বলেন, ‘বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। আজ সন্ধ্যায় ওই মেয়েটির সঙ্গে কথা হয়েছে, তাকে বলেছি যে কোনো সমস্যা মনে হলেই ফোন করতে। আর ফোন করে ডাকলেই আমরা হাজির হব।’