বোন বড় হয়েছে। বিয়ের কথা বার্তা চলছে। পারিবারিক ভাবে মতের মিল হওয়ার পর আকদ এর দিন ধার্য্য করা হয়। অনুষ্টানের শেষে ছেলের বাড়ি থেকে নাকি রাতে ৫০ জন আমার বোনকে দেখতে আসবে।
নতুন আত্মীয়। তাদের জন্য যেমন তেমন খাবার করা যাবেনা। অনেক টাকার বাজার করলাম। দেখলাম ওরা বেশকিছু মিষ্টি নিয়ে এসেছে।ওরা চলে যাবার পর মা জানালো সকালে বোনের শ্বাশুর বাড়িতে মিষ্টি নিতে হবে আরো সাথে কত কী!! কয়েক কেজি আর সস্তা মিষ্টি চলবেনা। দামী নিতে হবে তাও কমপক্ষে দশ কেজি। বরপক্ষ নাকি সমাজকে দিতে হবে। নয়তো সমাজ নাকি বদনাম করবে।
এ কেমন সমাজ মাথায় আসেনা। ব্যাপারটা এমন যে মিষ্টি কোনোদিন চোখে দেখে নাই। আকদের দিন মসজিদে সমাজীদের মিষ্টি খাওয়ানো হইসে সেটা যথেষ্ট না।
আকদ এর আগে বিয়ের চুক্তি গুলো হয়ে যায়। আমার বাবা এলাকার মুরব্বীদের সাথে কথা বলে ফাইনাল সিদ্ধান্ত নেয় যে কাবিন ১৫ লক্ষ টাকা, স্বর্ণ দশ ভরি দিলে ওনি আত্নীয়তা করতে রাজি। বরপক্ষও কনফার্ম করে যে এক হাজার মানুষ না খাওয়ালে আর ফার্ণিচার ঠিকঠাক না দিলে ওরা আত্নীয়তা করবেনা।শেষ পর্যন্ত সবকিছু মেনে নিয়ে বিয়েটা ঠিক হয়। এসব বিষয়ে বড়দের মুখের উপর বলতে নেই দেখে কিছু বলতে পারলাম না।
বরপক্ষ একহাজার। আমাদের ৫০০-৭০০ মানুষ হবে এমন একটা হিসাব করে আয়োজন করা হয়। বাসায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল অমুকের তমুককেও দাওয়াত করতে হবে। কাজে কামে নাকি আত্নীয়স্বজনের পরিচয়। তাই বলে লতা দিয়ে পাতা!! ঐ যে বড়দের উপর কথা বলতে নেই।
বিয়ের দিন দেখলাম আমি যে বড় ভাইকে দাওয়াত দিলাম ওনি মোটর সাইকেলের পিছনে আরো দুজন নিয়ে হাজির। ছোট ভাইয়ের বন্ধুরা নিজেদের বন্ধুদের নিয়ে হাজির যাদের কিনা ছোট ভাই নিজেই চিনেনা। ফলাফল খাবার সংকট। মানসম্মানের ব্যাপার। দ্রুত অতিরিক্ত বাজার করে রান্না করতে হল।
প্রচলিত নিয়ম মেনে বিয়ের পর দিন বোনের শ্বাশুর বাড়িতে আমাদের দুইশ জনের দাওয়াত। বৌ ভাত যাকে বলে। নিয়মের বাইরে যাওয়া যাবেনা বলে কিছু বলতে পারলাম না। অনেক টাকা গাড়ীভাড়া, অন্যানা খরচ গেলেও লতা দিয়ে পাতা হওয়া আত্নীয়দেরও দাওয়াত খাওয়াতে নিয়ে গেলাম। এরপর নাকি জামাইর বাড়ির দুশজন খাওয়াতে হবে। নয়তো কথা থেকে যাবে। সেটাও করতে হল ইচ্ছার বিরুদ্ধে।
বাসায় প্রশ্ন করলাম এতকিছুর দরকার কি? বলল এটাই করতে হবে। এটাই সঠিক। আমাদের মেয়েকে এরা সুখে না রেখে যাবে কই? কিন্তু আসলেই কি এটা সুখ? লতা দিয়ে পাতা হওয়া আত্নীয়কে দাওয়াত করে খাওয়ালে সুখ!!
যাই হোক সব শেষ করলাম। কিছু টাকা ঋণ নিতে হল বোনের সুখ কেনার জন্য। কিন্তু পরিপূর্ণ সুখ কিনতে রমজানের ঈদে জামাইর বাড়ির চৌদ্দ গোষ্ঠীর জন্য কাপড় দিতে হল। কোরবানীর ঈদে গরু দিতে হল। আর বারো মাসে তেরো রকমের জিনিস দিতে হল।
এর মধ্যে বোনের বাচ্চা হয়। আকীকা করানোর সময় আবার গরু দিতে হল। বোনের দেবর, ননদের বিয়ে হয় স্বর্ণ দিতে হল। দাওয়াত খাওয়াতে হল। এতকিছু করতে করতে ঋণের টাকা অনেক মাথায়। নিজের বিয়ের বয়সটাও চলে যাচ্ছে। ঋণ শোধ করে, নিজের বিয়ের জন্যও এতকিছু করার প্রস্তুতি নিতে হবে। ততদিনে বুড়া হয়ে যাব। বিয়ের আর দরকার কী!!
দুঃখের বিষয় হল যার সুখের জন্য এতকিছু করলাম, পারিবারিক জটিলতার কারণে তারই ডিভোর্স হয়ে গেল। তাহলে সুখ কই? সুখ এমন এক জিনিস যেটা টাকাতে পাওয়া যায় না। এর জন্য শিক্ষা আর সুন্দর একটা মন দরকার।
সুখের জন্য এসব জাস্ট তিন নাম্বার হাত “অযুহাত” এই চট্টগ্রামে। এটা নিয়ে গর্বের কিছু নাই। নিজের পরিশ্রমের টাকা লতা দিয়ে পাতা হওয়া আত্মীয়দের খাওয়ানোর দরকার নেই। কেউ খুশি মনে সামর্থ্য আছে বলে এসব করলে বাধা নেই। তবে নিয়ম মেনে করতে গেলে অবশ্যই আমার চুলকানি আছে।
এ কেমন সংস্কৃতি, যে নিয়মে বিয়ে করতে পাচ-সাত লক্ষ খরচ করতেই হবে!! টাকা কি গাছে ধরে? আর দাওয়াত দিলে নিজের সাথে মোটরসাইকেল আছে বলে হুদাই অতিরিক্ত দুজন নেয়া বন্ধ করুন। দুইশ টাকা খরচ করলে খাবার রেষ্টুরেন্টে অভাব নাই। অত ক্লোজ কেউ না হলে দাওয়াত পাওয়া মাত্র দৌড় দিয়েন না।
এসব অপসংস্কৃতির কারণে চট্টগ্রামে একটা মেয়ে বিয়ে দিতে যেমন বাপ ভাইয়ের পাছার চামড়া চলে যায়, তেমনি ছেলে বিয়ে করতে গেলেও বয়স হয়ে মাথার চুল চলে যায় এত লক্ষ টাকা ম্যানেজ করতে।
আবার অনেক মেয়েকে এমন বলতে শুনা যায়… আমি বাবার একমাত্র মেয়ে সুতরাং আমার জন্য খরচ না করে কার জন্য করবে…..
আসুন আমরা শিক্ষিত জেনারেশন সব বুঝি, ছেলেমেয়ে উভয়ই নিজ অবস্থান থেকে বদলে যাই।