সবেমাত্র নতুন মোবাইল কিনেছেন শফিকুল। আনন্দের যেন শেষ নেই তার। বন্ধুদের মধ্যে তারই একমাত্র মোবাইল তখন। চলতে ফিরতে যেখানেই বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয় সেখানেই আলোচনা শুধু মোবাইল কেন্দ্রিক। এরই মধ্যে নিজের নম্বরও দেয়া হয়েছে অনেককেই। শফিকুল যখন মোবাইল কেনেন তখন কলচার্জ (প্রতি মিনিট ভ্যাটসহ ৬ টাকা ৯০ পয়সা) বেশি হওয়ায় একে-অপরকে মিসকল দেয়ার প্রবণতাই বেশি ছিল।
একদিন দুপুরে শফিকুলের মোবাইলে একটি বাংলালিংক নম্বর থেকে মিসকল আসে। উল্টো শফিকুলও মিসকল দেয়। এরপর অপরপ্রান্ত থেকে আবারো মিসকল। নম্বরটি অপরিচিত হওয়ায় আগ্রহ জাগে শফিকুলের। এরপর সে ওই নম্বরে কল করে। অপরপ্রান্তে কিশোরীর কণ্ঠ শুনেই তরুণ শফিকুলের কথা বলার আগ্রহ বেড়ে যায়। দুই মিনিট কথা বলেই সেই দিনের কথোপকথনের সমাপ্তি ঘটে। প্রথম দিনের কথোপকথনে বেশ পুলোকিত হয়ে শফিক। এ জন্য পরদিনও মিসকলের অপেক্ষা করতে থাকে সে।
দিন গড়িয়ে যায়, কিন্তু মিসকল আসে না। একদিন সন্ধ্যায় মিসকল আসে তার নম্বরে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে শফিকুল। মিসকল দেখে বেজায় খুশি সে। দ্বিতীয় দিন অনেকক্ষণ কথা হয় তাদের মধ্যে। সেদিন বিস্তারিত পরিচয় হয় কিশোরী রিমা ও শফিকুলের মধ্যে।
শফিকুলের ভাষায় যেন একটি সম্পর্কের নিবন্ধন হয় সেদিন। এভাবেই কেটে যায় সাড়ে তিন বছর। গড়ে ওঠে গভীর প্রেমের সম্পর্ক। এরপর সাধ জাগে একে অপরকে দেখার। শফিকুল সিদ্ধান্ত নেয় সে দেখা করবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সে রাজশাহী শহরের পাঠানপাড়া থেকে ছুটে যায় চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলায়।
শফিকুলের সঙ্গে ইতোমধ্যে যে কিশোরীর মোবাইলে কথোপকথন ও প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার বাড়ি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলায়। সেখানকার একটি জায়গায় দেখা হয় তাদের। প্রথম দেখাতেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয় তারা। এরপর ওইদিনও চলে আসে শফিকুল। ইতোমধ্যে ঢাকায় একটি গার্মেন্টে চাকরি হয় তার। দেখা করে আসার দেড় বছর পর দুই পরিবারের সম্মতিতে ২০১০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে হয় তাদের। ঘটনার শুরুটা ছিল ২০০৫ সালে।
শুরু হয় তাদের সংসার জীবন। স্ত্রীকে নিয়ে থাকা শুরু করেন সাভারে। তখন সেখানেই চাকরি ছিল শফিকুলের। বছর শেষে তাদের ঘর আলো করে আসে সন্তান ওমায়ের। তার বয়স এখন ৭ বছর। সবকিছুই খুব সুন্দরভাবেই চলছিল শফিকুলের। তিনজনের সংসারে আনন্দের কমতি ছিল না। সুখের সংসার বলতে যা বোঝায় সেটিই ছিল রিমা ও শফিক দম্পতির মধ্যে।
এরপরই তাদের জীবনে নেমে আসে এক দুর্যোগ। আগের সেই সুখগুলো পরিণত হয় করুণ কাহিনীতে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন রিমা। তাৎক্ষণিকভাবে সাভারের সুপার মেডিকেলে ডাক্তারের কাছে নেয়া হয় তাকে। সেখানে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে জানতে পারেন অ্যাকিউট মাইলয়েড লিউকেমিয়া ভাইরাসে (ব্লাড ক্যান্সার) আক্রান্ত রিমা। সেখানকার ল্যাব প্রধান হাবিব, শফিকুলকে পরামর্শ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে তার স্ত্রীকে দেখানোর জন্য। পরামর্শ অনুযায়ী স্ত্রীকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে যান শফিকুল। সেখানে হেমাটোলজি বিভাগে ভর্তি করা হয় রিমাকে। সেখানেও বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় তার। একই সমস্যা দেখা দেয় সেখানেও। স্ত্রীকে নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ছুটোছুটি করতে চাকরিটাও চলে যায় শফিকুলের। স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে আবারও অসহায় হয়ে পড়েন তিনি।
কোনো উপায় না পেয়ে স্ত্রীকে নিয়ে চলে যান শ্বশুরবাড়ি সন্দ্বীপে। সেখানে শ্বশুরের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেন ভারতে নিয়ে যাবেন স্ত্রীকে। ইতোমধ্যে পাসপোর্ট ও ভিসার কাজও সেরে ফেলেন তিনি। বিভিন্ন জায়গা থেকে ধারদেনা করে আট লাখ টাকা জোগার করে গত ১৫ অক্টোবর রিমাকে নিয়ে কলকাতার ঠাকুরবাড়ি এলাকায় সরজগুপ্ত ক্যান্সার সেন্টার ও রিসার্চ ইনস্টিটিউটে যান শফিকুল। সেখানেই ভর্তি করেন স্ত্রীকে। টানা ৪২ দিন আইসিইউতে থাকার পর কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠেন রিমা। এরপর তার বোনমেরু পরীক্ষা করা হয়। রিপোর্ট ভালো পাওয়া যায়। সেখানে ডাক্তার জয়দেব চক্রবর্তী ও পিপিগুপ্তের অধীনে চিকিৎসা শুরু হয় রিমার।
২১ দিন পর পুনরায় যেতে হবে এ নির্দেশনায় রিমাকে নিয়ে দেশে চলে আসেন শফিকুল। নির্দেশনা অনুযায়ী ২১ দিন পর আবারও কলকাতা যান তারা। পুনরায় সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে পান রিমার অবস্থা আগের মতোই। শারীরিক যা উন্নতি হয়েছিল তার চেয়েও খারাপ অবস্থা।
ইতোমধ্যে তিনবার স্ত্রীকে নিয়ে ওই হাসপাতালে নিয়ে যান শফিকুল। এ পর্যন্ত তিনটি থেরাপিও দেয়া হয়েছে তাকে। সবমিলে ১৭ লাখ টাকাও খরচ হয়েছে তার। সর্বশেষ ১ মার্চ দেশে ফিরেছেন তারা। ডাক্তার জয়দেব চক্রবর্তী ও পিপিগুপ্ত তাকে জানিয়েছেন, দেড় মাসের মধ্যে বোনমেরু ট্রান্সপ্লান্ট করতে হবে রিমার। এ জন্য শুধু চিকিৎসাবাবদ ভারতীয় ১৬ লাখ রুপি খরচের একটি চাহিদাপত্রও দিয়েছেন তারা।
দেশে ফিরে চট্টগ্রাম থেকে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় কার্যালয়ে আসেন শফিকুল ইসলাম। এর আগে কলকাতার ওই হাসপাতালে বাংলাদেশি এক রোগীর কাছে একটি জনপ্রিয় অনলাইন গণমাধ্যমকে মানবিক খবর প্রচারের খবর শুনে সেখান থেকেই এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
শফিকুল ইসলাম জানান, বোনমেরু ট্রান্সপ্লান্টের জন্য ইতোমধ্যে দুই শ্যালিকার বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। তাদের সঙ্গে ম্যাচিংও করেছে। এখন শুধু টাকা জোগার করার কাজ।
তিনি বলেন, বাংলাদেশি প্রায় ২২ লাখ টাকা প্রয়োজন। আমার আত্মীয়-স্বজন ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন মিলে ১০ লাখ থেকে ১২ লাখ টাকা ব্যবস্থা করে দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। আমার বিশ্বাস সেই টাকা জোগার করতে পারবো।
শফিকুল বলেন, এখন আমার চাকরিও নেই। বিভিন্ন জায়গায় চলাফেরা করছি মানুষের কাছে টাকা ধার নেয়ার জন্য। ছেলেটাকেও স্কুল থেকে বের করে দিয়েছে। কারণ বেতন দেয়ার সক্ষমতা তার বাবার নেই। মায়ের সঙ্গে কেঁদে কেঁদে দিন পার হচ্ছে তার।
তিনি বলেন, আমার স্ত্রীর কিছু হয়ে গেলে সন্তান এতিম হয়ে যাবে। তার মায়ের মতো করে লালনপালন করতে আমি পারবো না। অথচ আমার মৃত্যু হলে অন্তত মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হবে না ছেলেটা আমার। শুনেছি এবং দেখেছি হৃদয়বান মানুষগুলোর সহযোগিতায় মৃত্যুর মুখ থেকে ঘুরে আসছেন অনেকেই। কেউ যদি দয়া করে আমাকেও একটু সহযোগিতা করেন তাহলে আমার স্ত্রীকে বাঁচাতে পারবো।
শফিকুলের স্ত্রীকে বাঁচাতে সহযোগিতা করতে পারেন ০১৮২২-৫২৬০৮৪-০ নম্বরে (ডাচ বাংলা ব্যাংক রকেট করা)। সাহায্য পাঠাতে পারেন, রিমা বেগম, হিসাব নং ১৬৫১-৫১০১-১৭৬৭৪, ডাচ বাংলা ব্যাংক, হালি শহর, চট্টগ্রাম।
সূত্র- জাগো নিউজ