আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা আমাদের দেহকে রোগসৃষ্টিকারী এজেন্টদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহায়তা করে। যেসব এজেন্ট পরিবেশ-প্রকৃতি থেকে আমাদের দেহে প্রবেশ করে। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা যদি যথেষ্ট শক্তিশালী হয় তাহলে বিপজ্জনক এবং প্রাণের জন্য হুমকি হতে পারে এমন সব রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়।
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং নিয়মিত শরীর চর্চা এসব আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী রাখে। তেমনি এমন কিছু বিষয় আছে যেগুলো আপনার অজান্তেই আপনার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করছে। আসুন জেনেও নেওয়া যাক কোন অভ্যাসগুলো অজান্তেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংস করছে।
১. মদপান
নিয়মিত মদপান করলে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। অ্যালকোহলে থাকা টক্সিন বা বিষ শরীরে প্রবেশ করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংস করতে থাকে। মদ্যপানের ফলে যেসব সমস্যার সৃষ্টি হয় অ্যালকোহলিক লিভার ডিজিস (এএলডি) তার অন্যতম। বিশেষজ্ঞদের মতে, যেসব পুরুষ নিয়মিতভাবে ৪০ থেকে ৮০ গ্রাম এবং যেসব মহিলা ২০ থেকে ৪০ গ্রাম মদপান করেন দশ বছরের মধ্যে তাদের এএলডি রোগের জন্ম হয়। এই রোগে আক্রান্ত হলে লিভারের কোষসমূহ ক্রমান্বয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। মদ পাকস্থলি বা মূত্রাশয়ে জমা হয় না। মদ রক্তের সঙ্গে মিশে যায়। মদ কতটা সেবন করা হয়েছে, তা বুঝা যায়, লিভার কতটা নষ্ট হয়েছে তা দেখে।
২. অতিরিক্ত ভ্রমণ
আজকাল যেন দুনিয়াটা ঘুরে দেখা একটি রীতিতে পরিণত হয়েছে। আর যে যত বেশি স্থান দেখতে পারবে ততই যেন খ্যাতি। কিন্তু আপনি যদি প্রায়ই ভ্রমণ করেন বা আপনার যদি এমন কোনো চাকরি থাকে যার জন্য আপনাকে প্রচুর ভ্রমণ করতে হয় তাহলে আপনার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়বে। কারণ নতুন নতুন প্রাকৃতিক পরিবেশ, জলবায়ু, পানি এবং খাদ্য এবং বিশ্রামহীনতার কারণে আপনার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ওপর চাপ পড়ে।
৩. দেহের অতিরিক্ত ওজন
শরীরে অতিরিক্ত চর্বি হওয়া মানেই হচ্ছে শরীরে রোগের ছড়াছড়ি। আর এক্ষেত্রে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে চর্বি, হৃদরোগসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ার ঝুঁকি বাড়ে। বিজ্ঞানীরা জনান, এজন্য মানুষের বয়স ও উচ্চতা অুযায়ী যতটুকু ওজন দরকার, তার চেয়ে তিন কেজি বেশি হলেই ডায়াবেটিস হওয়ার আশংকা ২৫-৩০ ভাগ দেহে অতিরিক্ত চর্বি জমা হওয়ার ফলে হরমোনগত ভারসাম্যও নষ্ট হয়। আর তার ফলে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে।
৪. দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ
ব্রিটিশ মনোবিজ্ঞানী অ্যাডাম বোরল্যান্ড বলেন, সীমিত মানসিক চাপ আমাদের প্রতিদিনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে সহায়তা করে। মানসিক চাপযুক্ত পরিস্থিতিতে আপনি যতো বেশি পড়বেন, তা সামলানোর দক্ষতাও আপনার মধ্যে ততো বাড়বে। কিন্তু মানসিক চাপ বা উদ্বেগ মানুষের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী সমস্যারও জন্ম দেয়। অতিরিক্ত ওজনের মতোই দীর্ঘমেয়াদের স্ট্রেস বা মানসিক চাপে আক্রান্ত হলেও রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। স্ট্রেসের ফলে দেহে স্ট্রেস হরমোন কর্টিসোল এর মাত্রা বেড়ে যায়। কর্টিসোল এর মাত্রা বেড়ে গেলে তা রোগ-বালাই সৃষ্টিকারী উপাদানের বিরুদ্ধে দেহের লড়াই করার সক্ষমতা নষ্ট করে।
৫. নিঃসঙ্গতা
নিজের মতো একা থাকা আর একাকী বোধ করার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। নিঃসঙ্গতার বোধ হৃদয়ের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। এমন অনেকে আছেন যারা তাদের জীবনের বেশিরভাগ সময় ঘরে একাকি কাটিয়ে দিতে পছন্দ করেন। এতে মস্তিষ্কে ডোপামিনের মাত্রা কমে যায়। কেননা একাকি থাকার ফলে নিঃসঙ্গতার বোধ এবং অবসাদ বেড়ে যায়। মস্তিষ্কে ডোপামিন এর মতো উপকারী হরমোন নিঃসরনের হার কমে গেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যায়। ডেনমার্কের ‘কোপেনহেগেন ইউনিভার্সিটি হসপিটাল’য়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে একাকিত্ব হৃদযন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর এবং মৃত্যু ঝুঁকি প্রায় দ্বিগুন করে তুলতে পারে। একা থাকার তুলনায় নিজেকে একা অনুভব করা হৃদরোগীদের স্বাস্থ্যগত পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তোলে। ডেনমার্কের কোপেনগেহেন ইউনিভার্সিটি হসপিটালের পিএইচডি’র শিক্ষার্থী অ্যানি ভিনগার্দ ক্রিস্টেনসেন বলেন, “আগের তুলনায় বর্তমানে নিঃসঙ্গতা বোধ বেশি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রচুর মানুষ একা বাস করেন।”
৬. আবেগ দমন করা
আবেগ এক ধরনের অনুভূতি। এর মধ্যে ভালোবাসা, ঘৃণা, সুখ, দুঃখ, দুশ্চিন্তা, রাগ, বিশ্বাস, ভয় ইত্যাদি রয়েছে। আপনি যদি এমন কেউ হন যিনি রাগ, দুঃখ, উত্তেজনা প্রকাশ না করে অবদমন করেন তাহলে আপনি আপনার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করছেন। কারণ গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, আবেগ দমন করলে দেহে কর্টিসোল এর মাত্রা বেড়ে যায়। যার ফলে রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। সুতরাং আবেগগুলোকে দমন না করে বরং নিয়ন্ত্রিতভাবে প্রকাশ করুন।
৭. অপুষ্টি
রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস জরুরি। আপনি যদি এমন একটি ভারসাম্যপূর্ণ খাদ্যাভ্যাস মেনে না চলেন যাতে সব ধরনের জরুরি পুষ্টি উপাদানগুলো থাকে, যেমন, ভিটামিন, প্রোটিন, খনিজ, স্বাস্থ্যকর চর্বি, আঁশ, ইত্যাদি তাহলে আপনার শরীরে পুষ্টির ঘাটতি দেখা দিবে বা আপনি অপুষ্টিতে আক্রান্ত হবেন। এতে আপনার রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়বে। সুতরাং সুস্থ্য থাকতে চাইলে পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে।
৮. অ্যান্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত ব্যবহার
সাধারণত বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ থেকে বাঁচতে আমরা বিভিন্ন প্রকার অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে থাকি। এই অ্যান্টিবায়োটিক আমাদের শরীরে থাকা ব্যাকটেরিয়াগুলোকে মেরে আমাদের রোগ মুক্তিতে সাহায্য করে। যদি সঠিক পরিমাণে এবং পর্যাপ্ত সময় ধরে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার না করা হয় তাহলে ব্যাক্টেরিয়াগুলো পুরোপুরি ধ্বংস হয় না এবং বেঁচে যাওয়া ব্যাকটেরিয়াগুলো আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ফলে এই ব্যাক্টেরিয়ার বিরুদ্ধে উক্ত এন্টিবায়োটিক আর কাজ করে না। আর এ অবস্থাকে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বলে। পাশাপাশি অহেতুক এবং অনিয়ন্ত্রিত অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার রক্তের শ্বেতকণিকাগুলোকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। যার ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়।
৯. পানিশূন্যতা
আমরা জানি যে পানি কম খেলে, অতিরিক্ত ঘামলে কিংবা অনেক বেশি ব্যায়াম করলে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। পানিশূন্যতা হলেই শরীরে নানান রকম সমস্যা দেখা দেয়। শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াগুলো ব্যহত হয়। সেই সঙ্গে মানসিক ভাবেই বিষণ্ণ অনুভূত হতে থাকে। আপনি যদি প্রতিদিন অন্তত দুই লিটার পানি না পান করেন তাহলেই আপনার দেহে পানিশুন্যতা দেখা দিবে। যার ফলে নানা রোগ-বালাই আক্রমণ করবে। পানিশুন্যতা আপনার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকেও দুর্বল করে দিবে। কেননা পানির অভাবে রক্তের শ্বেতকণিকাগুলো শুকিয়ে যায়।
১০. অপর্যাপ্ত ঘুম
প্রতিদিন রাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের শারীরিক সুস্থতার জন্য অত্যন্ত জরুরি। আর কম ঘুম স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এটা কতোটা ক্ষতিকর তা সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে। দ্য স্লিপ কাউন্সিলের ওই গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ দিনে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা বা তার চেয়ে কম ঘুমান। ফলে তাদের শরীর, মন ও মস্তিষ্কে এর অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে এবং ধীরে ধীরে দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নাজুক হতে শুরু করে। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, যারা দিনে আট ঘণ্টার কম ঘুমান, তাদের অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি ক্রমশ বাড়ছে। কারণ অপর্যাপ্ত ঘুম অস্বাভাবিক মৃত্যুর আশঙ্কা ১৫ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়।
১১. অনলাইনে অতিরিক্ত সময় কাটানো
প্রযুক্তির এই যুগে নানান ধরনের গেজেট বা ইলেকট্রনিক ডিভাইস আমাদের নিত্যসঙ্গী। প্রতিনিয়তই আমরা কোন না কোন ডিভাইস বা যন্ত্র ব্যবহার করছি। যন্ত্রের যাঁতাকলে জীবনটাই যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে। এর সাথে যোগ হয়েছে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা ও অতিরিক্ত ব্যবহার। দিনের উল্লেখযোগ্য একটা সময় আমরা এখন অনলাইনে ব্যয় করি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যারা অনলাইনে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করেন, তাদের স্মৃতিশক্তি লোপ পায়। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো ব্রাউজিংয়ে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করলে তা স্মৃতিকে আঘাত করে, এমনকি ব্যক্তি তার গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটিও ভুলে যেতে পারেন বা হারাতে পারেন। আর এ কথা নিশ্চিয়ই আপনার জানা আছে যে, মস্তিষ্ক সুস্থ না থাকা মানে দেহের বিভিন্ন অঙ্গ দুর্বল হয়ে পড়া। দুর্বল অঙ্গে প্রতিরোধহীন ভাবেই রোগ আক্রমণ করবে এটাই কি স্বাভাবিক নয়!