অধিকাংশ কিডনি রোগ কোনো লক্ষণ ছাড়াই ভিতরে ভিতরে জটিল হতে থাকে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যখন ধরা পরে ততদিনে আপনি বিছানায় শয্যাশায়ী। প্রায় ১৪ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ কিডনির বিভিন্ন রোগে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং একসময় অন্য জটিল কোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়ে শোনেন তিনি কিডনি রোগেও আক্রান্ত। কিন্তু তিনি যদি আগেই টের পেতেন তার এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটি ঠিক মত কাজ করছে না, নিশ্চয়ই সতর্ক হতেন। যেমনটি আপনার মনেও ইতিমধ্যে ঘণ্টা বেজে গিয়েছে, “আমিও কি কিডনি রোগে আক্রান্ত?” দাঁড়ান দাঁড়ান, বিচলিত হবেন না। আগে দেখে নিন নিচে উল্লেখিত লক্ষণগুলো আপনার রয়েছে কিনা।
১. চুলকানি এবং ত্বকের শুষ্কতা
আপনার কিডনি দেহের জন্য ক্ষতিকর এবং বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেওয়ার জন্য অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে। তারা রক্ত উৎপাদনে অংশ নেয় এবং প্রয়োজনীয় খনিজ উপাদানের ভারসাম্য রক্ষা করে। ত্বকের শুষ্কতা, চুলকানি, অবাঞ্ছিত দাগ, র্যাশ কিংবা জন্ডিস হওয়া, এসব নির্দেশ করে কিডনি তার স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। এইসব অপ্রীতিকর লক্ষণ দেখা দেওয়ার পেছনে মূল কারণ হতে পারে দেহের অতিরিক্ত ফসফরাস যৌগটি শরীর থেকে বেরিয়ে যেতে পারছে না অথবা দেহের বর্জ্য পদার্থ দেহেই থেকে যাচ্ছে।
২. সব সময় শরীর গরম থাকে
রক্তস্বল্পতায় আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর গরম থাকা, জ্বর, ক্লান্তি, শ্বাস কষ্ট, অনিদ্রা ইত্যাদি লক্ষণ অপরিচিত কিছু নয়। কিডনি সমস্যার কারণে এরিথ্রোপোয়েটিন হরমোনের উৎপাদন হ্রাস পায়। এই হরমোন অস্থি মজ্জায় রক্ত কণিকার উৎপাদন প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করে। দীর্ঘদিন ধরে রক্তস্বল্পতায় আক্রান্ত থাকলে বুঝবেন আপনার কিডনি ঠিকমত কাজ করছে না এবং এরিথ্রোপোয়েটিন হরমোনের সমস্যা চলছে।
৩. মুখে দুর্গন্ধ
বিভিন্ন রোগের কারণে আপনার মুখে দুর্গন্ধ হতে পারে, কিন্তু এদের মধ্যে অন্যতম কারণ হলো মূত্রনালির সংক্রমণ। যখন কারো কিডনিতে সমস্যা চলে, দেহের বিপাকীয় বর্জ্য পদার্থ দেহের যেকোনো উন্মুক্ত জায়গা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, তাই তারা গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল ট্র্যাক্টেও ঢুকে পড়ে। ফলে মুখে ধাতব পদার্থের স্বাদ অনুভূত হয় আর তৈরি হয় মৃদু অ্যামোনিয়ার (এক ধরনের রাসায়নিক) গন্ধ।
৪. অস্বাভাবিক স্ফীতি
ইন্ট্রা-সেলুলার স্পেসে অতিরিক্ত পানি জমে দেহের বিভিন্ন অঙ্গে অস্বাভাবিক স্ফীতি দেখা দেয়। প্রথমে তারা জমা হয় পায়ে, মুখমণ্ডলে এবং চোখের পাতায়- কিন্তু পরে, তারা পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এই অস্বাভাবিক স্ফীতি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং চেহারা ফ্যাকাসে ও ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়। যদি ফুলে যাওয়া অংশে আঙুল দিয়ে চাপ দেন, তাহলে গর্ত তৈরি হবে এবং কিছুক্ষণের মধ্যে তা মিলিয়েও যাবে। অন্য আরো কিছু স্নায়ুবিক সমস্যা এর সাথে তৈরি হয়, যেমন অনিদ্রা, মাইগ্রেনের ব্যথা এবং হাড় ও মাংসপেশির ব্যথা। ডাক্তাররা মনে করেন এই অস্বাভাবিক স্ফীতি তখনই দেখা দেয় যখন সোডিয়াম আয়ন বিপুল পরিমাণ তরলকে আকর্ষণ করে।
৫. অতিরিক্ত হৃৎস্পন্দন
কিডনি সমস্যার কারণে দেহের বিপাক প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত যে অতিরিক্ত পরিমাণ পটাশিয়াম শরীর থেকে বের হতে পারে না, তা আমাদের কার্ডিওভাসকুলার সিস্টেমের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটি হৃৎস্পন্দনে যে অস্বাভাবিকতা তৈরি করে তার সত্যি খুব মারাত্মক। দেহে পটাশিয়াম বেড়ে গিয়ে হাইপারক্যালেমিয়া হওয়ার বিষয়টি কেবল ল্যাব টেস্টেই ধরা পরে। কারণ এর লক্ষণগুলো এতই অস্পষ্ট যে অন্যান্য রোগরে লক্ষণের সাথে গুলিয়ে ফেলতে হয়।
৬. প্রচণ্ড জ্বর এবং পিঠ ব্যথা
প্রচণ্ড জ্বরের সাথে পিঠ ব্যথা, ঘন ঘন প্রস্রাব এবং কখনো কখনো বমি হওয়া প্রমাণ করে আপনার কিডনিতে সমস্যা হয়েছে। আবার মূত্রতন্ত্রের জটিল অবস্থানের কারণে পুরুষদের চেয়ে বেশি নারীরা অধিক মাত্রায় সংক্রমণের স্বীকার হয়ে আলোচ্য সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হতে পারেন। যদি আপনার এমন উপসর্গ দেখা দেয়, আপনার উচিৎ হবে দ্রুত ডাক্তার দেখানো। ডাক্তার যথাযথ ওষুধ পত্রের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করবেন।
৭. মাসল ক্রাম্প (পেশি টান বা খিঁচুনি)
দীর্ঘদিন ধরে প্রায়ই আপনার পেশিতে টান লাগে বা খিঁচুনি হয়? এর কারণ হতে পারে দেহে জরুরি খনিজ পদার্থের ভারসাম্যহীনতা। আমাদের দেহের পেশিগুলো সঠিক ভাবে কাজ করার জন্য ম্যাগনেসিয়াম এবং পটাশিয়ামে ভারসাম্য থাকা জরুরি। এদের ভারসাম্য নষ্ট হলে মাসল ক্রাম্প হতে দেখা যায়। শুধু এদেরেই দোষ দিলে চলবে না। মাসল ক্রাম্পের জন্য দেহে অতিরিক্ত তরলের উপস্থিতিও দায়ী। আর এসব তখনই ঘটে যখন আপনার কিডনি দুটি তার স্বাভাবিক কাজ করতে পারে না।
৮. উচ্চ রক্তচাপ
উচ্চ রক্তচাপ কিডনির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। উচ্চ রক্তচাপ রক্তনালীকে ক্ষতিগ্রস্ত করার মাধ্যমে কিডনি ফেইলিয়্যুর পর্যন্ত ঘটাতে পারে। যদি রক্ত প্রবাহ খুব প্রবল হয়, তাহলে রক্তনালী উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে পড়ে তা দুর্বল হতে থাকে। ফলে কিডনির পক্ষে দেহের দূষিত পদার্থ বের করে দেওয়া কঠিন হয়ে যায়। তার উপর দেহে যে অতিরিক্ত তরল জমা শুরু করে তা পরিস্থিতিকে আরো ভয়াবহ করে তোলে। বিশেষজ্ঞদের মতে উচ্চ রক্তচাপ কিডনি রোগের অন্যতম প্রধান কারণ।
৯. প্যানিক অ্যাটাক
খুব উদ্বিগ্ন বা প্রচণ্ড আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে হার্ট অ্যাটাকের মত অনুভূতি হওয়ার নাম প্যানিক অ্যাটাক। যদিও নানা প্রচণ্ড মানসিক চাপ, দীর্ঘ দিনের ক্লান্তি, অবসাদ ইত্যাদি কারণে প্যানিক অ্যাটাক হয়ে থাকে তবুও চিকিৎসক আপনাকে কিডনি পরীক্ষা দিলে অবাক হবেন না। অসুস্থ কিডনি প্যানিক অ্যাটাকের বিষয়টি বাড়িয়ে দিতে পারে।
১০. ত্বকের ফুসকুড়ি
যেহেতু কিডনি সমস্যায় দেহে অতিরিক্ত পানি জমে সেহেতু আপনার ত্বকে ফুসকুড়ি দেখা দেওয়া অসম্ভব কিছু না। কারণ ইন্ট্রা-সেলুলার স্পেসের এই তরল গুলো ত্বকের মধ্য দিয়েও বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। আর তখনি জন্ম নেয় ফুসকুড়ি। ইংরেজিতে যাকে র্যাশ বলে। এর আরেকটি কারণ হলো ইউরেমিক টক্সিন যা কিডনি শরীর থেকে বের করে দিতে পারছে না। এমন ফুসকুড়ি দেখা দিলে সতর্ক হোন এবং দ্রুত ডাক্তার দেখান।
কি মনে হচ্ছে? ডাক্তারের কাছে যেতে হবে? যদি তাই মনে করেন, দেরী করবেন না। ফোন হাতে নিন, ডাক্তারের সিরিয়াল দিন অথবা চলে যান হাসপাতালে। ইউরোলজি বিভাগের টিকিট কেটে ডাক্তার দেখিয়ে আসুন।