সুন্দর করে সাজানো রাশি রাশি ফুল। পাশে ফুলের মতোই প্রিয়ন্ময়ী। তবে সে আর সেই চঞ্চল শিশুটি নেই। ঘুমিয়ে আছে কফিনে। পাশের কফিনেই শুয়ে আছেন তার বাবা প্রিয়ক। কোনো কোনো ফুল পাশ থেকে আলতো করে ছুঁয়ে রেখেছে একেকটি কফিন। ওপরে কাগজে সাঁটানো হয়েছে নাম, পাসপোর্ট নম্বর, বক্সের নম্বর। স্বজনরা কফিন খুঁজে বের করে কান্নায় ভেঙে পড়ে। কেউ কেউ পরম মমতায় কফিনে হাত বোলায়। স্বজনরা একে অন্যকে জড়িয়েও কাঁদে। বুকফাটা কান্নার এই ঢেউ কয়েক ঘণ্টা পর ভাসায় ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামও।
গতকাল সোমবার বিমানবাহিনীর একটি পরিবহন বিমানে মরদেহগুলো নেপাল থেকে ঢাকায় হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে আনা হয়। সেখান থেকে জানাজার জন্য আনা হয় আর্মি স্টেডিয়ামে। দুপুর ২টার পর থেকেই স্টেডিয়ামে জানাজায় অংশ নিতে অনেকে হাজির হয়। বিকেল পৌনে ৩টা থেকে নিহতদের শোকার্ত স্বজনরা আসতে শুরু করে।
ভ্রমণে যাওয়ার দুই দিন আগে মন খারাপ ছিল প্রিয়কের মা ফিরোজা বেগমের। তা দেখে হেসে প্রিয়ক মাকে বলছিলেন, ‘দুশ্চিন্তা করছ কেন মা! ছয় দিন পরই তো ফিরে আসব।’ কিন্তু ছয় দিন পর নয়! তাঁর প্রাণপ্রিয় শিশুমেয়েকে নিয়ে প্রিয়ক ফিরলেন আরো এক দিন পর, তবে কফিনবন্দি হয়ে। এদিকে উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া প্রিয়কের স্ত্রী আলমুন নাহার অ্যানিকে গতকাল সোমবার বিকেলে জানানো হয়েছে স্বামী ও একমাত্র শিশুমেয়ের মৃত্যুসংবাদটি।
গতকাল বিকেলে দেশে প্রিয়ক ও তাঁর শিশুমেয়ের মরদেহ দেশে আসার পর সন্ধ্যায় নিয়ে যাওয়া হয় গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় গ্রামের বাড়িতে। রাত ৮টার দিকে বেজে উঠে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন। আর সাথে সাথে ডুপ্লেক্স বাড়িটি থেকে উঠে গগনবিদারী চিৎকার। সেখানে কফিন দেখেই চিৎকার দিয়ে মূর্ছা যান প্রিয়কের মা। চিৎকার করছেন অ্যানি- ‘আমার আর কেউ নেই, তোমরা সবাই চলে যাও। আমাকে একা থাকতে দাও।’ সেখানে থাকা সবার চোখে ছিল পানি, অনেকে গুমরে কেঁদে ওঠে।
গত সোমবার কাঠমাণ্ডুতে ইউএস-বাংলার বিএস-২১১ ফ্লাইটটি বিধ্বস্ত হলে প্রিয়ক ও তাঁর শিশুমেয়ে তামারা প্রিয়ন্ময়ী নিহত হয়। বেঁচে যান তাঁর স্ত্রী আলমুন নাহার এ্যানি, মামাতো ভাই মেহেদি হাসান মাসুম ও মাসুমের স্ত্রী সৈয়দা কামরুন নাহার স্বর্ণা। তাঁদের সবার বাড়ি গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার নগরহাওলা গ্রামে।
স্বজনরা জানায়, গতকাল দুপুরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে ইউএস-বাংলার ব্যবস্থাপনায় বিকেল সাড়ে ৩টায় স্বামীর বাড়ি নেওয়া হয় অ্যানিকে। সেখানে অ্যানির বাবা সালাউদ্দিন মাহমুদ খসরু ও বান্ধবী রাবেয়া আক্তার রাবু স্বামী ও মেয়ের মৃত্যুসংবাদ জানান এ্যানিকে। কিন্তু মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এ্যানি সন্ধ্যা পর্যন্ত তা বিশ্বাসই করছিলেন না। রাত ৮টায় দুটি কফিন দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন তিনি।
রাতে প্রিয়কের বাড়ি গিয়ে দেখা গেল, দোতলা বাড়ির সামনে দুটি কফিন রাখা। কফিন দুটি ঘিরে কয়েক শ মানুষ, সবার চোখেই অশ্রু। বাড়ির ভেতরজুড়ে চলছিল আহাজারি। স্বজন ও প্রতিবেশীরা কাঁদছে। একটি কক্ষে মূর্ছা যাওয়া প্রিয়কের মায়ের মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। পাশে আরেকটি কক্ষে শুয়ে বাকরুদ্ধ অ্যানি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছেন।