আপনি কি ধূমপান করেন? আপনার পরিবারে কি হার্ট অ্যাটাকের ইতিহাস আছে? আপনার কি উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তে চর্বির মাত্রা বেশি আছে? আপনি কি কায়িক শ্রমবিহীন জীবন যাপন করেন? আপনি কি স্থূল? আপনার মানসিক চাপ কি প্রচণ্ড?
কর্মক্ষম মানুষের অকালমৃত্যু ও অকালে কর্মহীন হয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হৃদরোগ। হৃদরোগ হলো নীরব ঘাতক। বড় ধরনের সমস্যা ঘটে যাওয়ার আগে প্রায়ই তেমন জানান দেয় না। দিব্যি সুস্থ সবলভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কেউ, কোনো সমস্যা নেই, একদিন হঠাৎ শোনা যায় তাঁর ‘ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক’ হয়ে গেছে। এ রকম হার্ট অ্যাটাকের পরিণতি হয় সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু, নয়তো জীবনের সঙ্গে আপস করে কোনোমতে চলা। তাই হৃদরোগ হওয়ার আগেই সাবধান হতে হবে।
আপনি কি ঝুঁকিতে আছেন?
কোনো সমস্যা বোধ করছেন না, বুকে ব্যথা করে না কখনো, অনেক পরিশ্রমও করতে পারেন, তার মানে আপনার কোনো দিন হার্ট অ্যাটাক হবে না—এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। কারও হৃদরোগ হওয়ার ঝুঁকি কতটুকু আছে, তা জানতে চিকিৎসকেরা কয়েকটি প্রশ্ন করে থাকেন। আপনি কি ধূমপান করেন? আপনার পরিবারে কি হার্ট অ্যাটাকের ইতিহাস বা অল্প বয়সে হঠাৎ মৃত্যুর ইতিহাস আছে? আপনার কি উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তে চর্বির মাত্রা বেশি আছে? আপনি কি কায়িক শ্রমবিহীন জীবন যাপন করেন? আপনি কি স্থূল? আপনার মানসিক চাপ কি প্রচণ্ড? এসব প্রশ্নের উত্তর যদি বেশির ভাগই ‘হ্যাঁ’ হয়, তবে আপনার হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেক।
নিজের হার্টকে জানুন
হার্টকে ভালোবাসতে হলে নিজের হার্ট সম্পর্কে জানা জরুরি। কখনো কি তার ভালোমন্দ জানতে চেয়েছেন? ভাবছেন হার্টের ভালোমন্দ আবার কী করে জানবেন? খুব সোজা। নিয়মিত রক্তচাপ মাপুন। বয়স ৩৫-এর ওপর হলে বছরে বা দুই বছরে একবার রক্তে শর্করা ও চর্বির পরিমাণ পরীক্ষা করে নিন। উচ্চতা অনুযায়ী আপনার ওজন ঠিক আছে কি না, তা বিএমআই ক্যালকুলেটরে হিসাব করে নিন।
সবাই মিলে হার্টের যত্ন নিই
নিজের ও নিজের পরিবারের শুধু নয়, সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে সবারই দায়বদ্ধতা দরকার। সুস্থ সুষম খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত হাঁটা বা ব্যায়াম, প্রতিদিন তাজা শাকসবজি, ফলমূল গ্রহণ, লবণ-চর্বি ও তেলযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা, ধূমপান-জর্দা তামাককে ‘না’ বলা, প্রতিদিন ৭-৯ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন রাতের ঘুম, অতিরিক্ত মানসিক চাপ এড়াতে আনন্দময় পারিবারিক বন্ধন ও বন্ধুত্ব গড়ে তোলা, শখের চর্চা—এ রকম নানা ছোট ছোট পরিবর্তনের মাধ্যমেই আপনি নিজের ও সবার হার্টের যত্ন নিতে শুরু করতে পারেন। সেই শুরুটা আজই হোক না কেন।
হৃদরোগ নিয়ে যত ভ্রান্তি
হার্ট নিয়ে আমরা সবাই কম-বেশি চিন্তিত। কখনো বুকে চিনচিন ব্যথা করে উঠলে দুশ্চিন্তায় ডুবে যাই—হার্টে সমস্যা হচ্ছে না তো? আবার কেউ বলেন, আরে, তুমি এত স্লিম, তোমার কি আর হার্টের রোগ হবে? আসলে হৃদরোগ নিয়ে আমাদের সবার আছে নানা ভ্রান্ত ধারণা। দেখা যাক এগুলো কী।
বুকে তো ব্যথা নেই!
কখনোই বুকে ব্যথা হয়নি, বুকে চাপ ধরে আসেনি, মোট কথা কোনো লক্ষণই নেই। তারপরও কিন্তু আপনার হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। ডায়াবেটিসের রোগীদের সাধারণ উপসর্গগুলো প্রায়ই হতে দেখা যায় না। তাদের সাইলেন্ট অ্যাটাক হওয়ার আশঙ্কা বেশি। স্নায়ুজনিত সমস্যায়ও তাই। অনেকে কিছু ওষুধ খান, যা হৃদরোগের উপসর্গগুলোকে ঢেকে দেয়। কখনো হার্টের ব্যথাকে পেট ব্যথা, গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা বা বদহজম বলে ভ্রম হয়। তাই হৃদরোগ থাকলে সব সময় বুকে ব্যথা হবেই এমন কোনো কথা নেই। দুটো বিষয় খেয়াল রাখবেন। এক. চল্লিশের পর যেকোনো বুক ব্যথাকে আমলে নেবেন, গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা বলে উড়িয়ে দেবেন না। দুই. কোনো উপসর্গ না থাকলেও যদি আপনার ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ থাকে, রক্তে চর্বি বেশি থাকে, পরিবারে হৃদরোগের ইতিহাস থাকে বা আপনি ধূমপায়ী হোন, তবে হৃদরোগের ঝুঁকি কিন্তু রয়েই গেছে।
ইসিজি স্বাভাবিক, তাই নিশ্চিন্ত?
মাঝে মাঝে বুক ব্যথা হয় বা চাপ ধরে আসে। একটু পরিশ্রমে হাঁপিয়ে ওঠেন। সন্দেহ হলে ইসিজি করেছেন। ইসিজির রিপোর্ট স্বাভাবিক, তাই নিশ্চিন্ত হয়ে আছেন। আপনার হৃদরো নেই? এটাও ভুল ধারণা। হৃদযন্ত্রে রক্তপ্রবাহ কমে গেলে বা হৃদযন্ত্রের রক্তনালিতে ব্লক থাকলে সব সময় ইসিজিতে ধরা পড়বে তা নয়। ঠিক ব্যথার সময় ইসিজি না করা হলে তা স্বাভাবিকও পাওয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে আপনার ঝুঁকি প্রবল থাকলে ও উপসর্গ থাকলে চিকিৎসক আপনাকে ইটিটি বা এনজিওগ্রামের পরামর্শ দিতে পারেন। দেখা গেল ইসিজি স্বাভাবিক থাকলেও এনজিওগ্রামে রক্তনালিতে বাধা দেখা যাচ্ছে।
স্লিম মানুষের ভয় নেই?
রোগা ও স্লিম মানুষের রক্তে চর্বি বেশি থাকার কথা নয়। এদের হৃদরোগই-বা কেন হবে। এই ধারণাও ভুল। স্থূলতায় ঝুঁকি আছেই, রোগাদেরও উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে কোলেস্টেরল বেশি থাকতে পারে বা হৃদরোগ হতে পারে। মেয়েদের হার্টের অসুখ হয় না
মেয়েদের হার্ট অ্যাটাক হওয়ার আশঙ্কা কম—আজকাল এ ধারণাও ভুল প্রমাণিত হচ্ছে। স্থূলতা, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতা, রক্তে চর্বির আধিক্য নারীদের হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। মেনোপজের পর একজন নারীর হৃদরোগের ঝুঁকি পুরুষদের সমানই হয়ে যায়। এখন পর্যন্ত বয়স্ক নারীদের (৬৫ বছরের বেশি) মৃত্যুর সবচেয়ে প্রধান কারণ হচ্ছে হার্ট অ্যাটাক।
হৃদরোগের ৬টি বিরল ও বাহ্যিক লক্ষণ
হৃদরোগ এমন একটি রোগ যা আমরা কখনও আগে টের পাই না। হার্ট অ্যাটাক হলেই বুঝতে পারি আমরা হৃদরোগে আক্রান্ত। কিন্তু এমন কিছু শারীরিক চিহ্ন/উপসর্গ আছে যা দেখে বুঝা যাবে হৃদরোগে আক্রান্ত হতে যাচ্ছেন আপনি।
১. কানের লতিতে ভাঁজ: কানের লতি নিয়ে হৃদরোগের আগমনী বার্তাটি প্রথম আবিষ্কার করেন আমেরিকান ডাক্তার স্যান্ডার্স ফ্রাঙ্ক। তারপর থেকে এই চিহ্নকে ফ্রাঙ্ক সাইন বলা হয়। সাধারণত কানের লতি সমতল হয়ে থাকে যদি কানের লতিতে ভাঁজ পড়ে তাহলে হৃদরোগের ঝুঁকিতে আছেন বুঝা যাবে।
যখনই হার্টের ধমনীতে রক্ত সংবহন বাধাপ্রাপ্ত হয় তখনই কানের লতিতে ভাঁজ পড়ে থাকে। অনেক মেডিকেল বিশেষজ্ঞ মনে করেন কানের লতিতে ভাঁজ বার্ধক্যের লক্ষণ। তবে গবেষকরা গতবছর সর্বাধুনিক সিটি স্ক্যান মেথড ব্যবহার করে কানের লতিতে ভাঁজ হৃদরোগের পূর্বাভাস হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
২. শরীরে হলুদ অতিরিক্ত অংশ: হৃদরোগের আরেকটি চিহ্ন হলো শরীরের বিভিন্ন অংশে অতিরিক্ত অংশ। এসব অতিরিক্ত অংশ দেখতে আচিলের মতো। সাধারণত কনুই, হাটু, নিতম্ব ও চোখের পাতায় হয়ে থাকে। এসব দেখতে ক্ষতিকর না হলেও এটা বিরাট সমস্যার একটি চিহ্ন।
৩. নখের আকার পরিবর্তন: নখের গঠনে তারতম্য বা পরিবর্তন দেখে বোঝা আপনার হার্টের অবস্থা কি। যখন দেখবেন হাতের নখের আকার পরিবর্তন হয়েছে বা অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়েছে তাহলে বুঝতে হবে হার্টের অবস্থা ভালো নয়। নখ যখন চামড়ার থেকে বেশি বেড়ে গিয়ে বেঁকে যায় তখন তাকে ক্লাবিং বলে। আঙ্গুলের টিস্যু গুলো মোটা হয়ে যাওয়ার কারণে সাধারণত এই রোগ গুলো দেখা দেয়। আর এরকম হওয়ার কারণ হলো হার্ট থেকে পর্যাপ্ত রক্ত আঙুলের নখে পৌঁছতে পারছে না। দেহে স্বাভাবিক রক্ত চলাচল থাকলেই সাধারণত নখের রং গোলাপি হয়। নখের নিচে অনেক সময় সরু এক চিলতে রক্তপাত দেখা যায়। একে বলা হয় স্প্লিনটার হেমরেজ। এটিও হৃদরোগের উপসর্গ।
৪. আইরিসের চারপাশে ধুষর বলয়: চোখের আইরিশের বাইরের প্রান্তে ধূসর, সাদা বা হলুদ অর্ধচক্র বা বৃত্তাকার বলয় থাকলে বুঝতে হবে আপনার রক্তে কলেস্টেরলের মাত্রা বেশি। যা হৃদরোগের চিহ্ন। আর এটাকে বলা হয় আর্কাস সিনিলিস। এটি আপনার দৃষ্টি প্রভাবিত করবে না। কিন্তু হৃদরোগের উপসর্গকে চিহ্নিত করে।
সাধারণত ৫০ থেকে ৬০ বছর বয়সী প্রায় ৬০ শতাংশ লোকের চোখে এই বৃত্তাকার বলয় দেখা যায়। ৮০ বছর পর, প্রায় ১০০ শতাংশ মানুষের চোখে এটা দেখা যায়। তবে বিশেষ করে যদি আপনার ৪০ বছর বয়সের আগে এই রোগ নির্ণয় করা হয়, তাহলে বুঝতে হবে আপনি হার্টের রোগের ঝুঁকিতে আছেন।
৫. দাঁতের ক্ষয়: আপনার দাঁতের অবস্থা বলে দিবে আপানর হার্টের কি অবস্থা। যদি দাঁতের গাম নষ্ট হয়ে দাঁতের ক্ষয় হতে থাকে বা দাঁত পড়ে যায় বা মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়ে তাহলে বুঝতে হবে হার্টের অবস্থা ভালো নয়। মুখের ভিতর ভালো ও খারাপ দু ধরণের ব্যাকটেরিয়া থাকে। আর খারাপ ব্যাকটেরিয়ার রক্তে প্রবেশ করে হার্টের ক্ষতি করে থাকে।
গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, দাঁতের অপরিষ্কার ও অপরিচ্ছন্ন অবস্থা এবং মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়ায় রক্তপ্রবাহে ৭০০ বেশি বিভিন্ন জীবাণু প্রবেশ করে। আর এর কারণে কেউ সুস্থ বা ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী হলেও তার হৃদরোগের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা ৩৯টি দেশের ১৫ হাজার ৮২৮ জনের ওপর গবেষণাটি চালিয়ে এ কথা জানান। এমনকি দাঁত পড়া মানে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ১১ শতাংশ।
৬. ঠোঁটের রং নীল: হৃদরোগের আরেকটি উপসর্গ হলো ঠোঁটের রং নীল হয়ে যাওয়া। সাধারণত স্বাভাবিক অবস্থায় ঠোঁটের রং লাল বা গোলাপি হয়ে থাকে। যখনই ঠোঁটের রং নীলচে বা নীলাভ হয়ে যায় তাহলে বুঝতে হবে হার্টে সমস্যা রয়েছে।
তবে হ্যা অনেক সময় অতিরিক্ত ঠাণ্ডা বা উচ্চতায় উঠলে ঠোঁটের রং নীল হতে পারে। এর কারণ হলো তখন হার্টে স্বাভাবিক অক্সিজেন চলাচল ঠিক থাকেনা।
যাই হোক উপরের চিহ্নিত লক্ষণ দেখে দুশ্চিন্তা না করে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়াটাই সবচেয়ে যৌক্তিক কাজ।
হৃদরোগের কারণ
আমাদের দেহের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ হচ্ছে হৃৎপিণ্ড। বুকের মাঝখানে দুই ফুসফুসের মাঝে এটি অবস্থিত। এর রয়েছে চারটি প্রকোষ্ঠ। ওপরের দুটিকে বলা হয় অ্যাট্রিয়াম বা অলিন্দ এবং নিচের দুটিকে বলা হয় ভেন্ট্রিকল বা নিলয়। আর হৃৎপিণ্ড তার চারপাশে পেরিকার্ডিয়াম নামক একটি আবরণী দ্বারা পরিবেষ্টিত।
হৃৎপিণ্ডকে আমরা বলতে পারি, এটি একটি পাম্প যা একজন মানুষের জীবদ্দশায় প্রায় সাড়ে চার কোটি গ্যালনের চেয়ে বেশি রক্ত পাম্প করে থাকে। প্রতিদিন প্রায় এক লক্ষবার হৃৎস্পন্দনের মাধ্যমে হৃৎপিণ্ড দেহের প্রতিটি কোষে প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও অক্সিজেন পৌঁছে দিচ্ছে। আর এটি সম্ভব হচ্ছে ধমনী শিরা উপশিরা ও ছোট ছোট রক্তনালী মিলিয়ে প্রায় ৬০ হাজার মাইল পাইপলাইনের মধ্য দিয়ে।
কেউ কেউ মনে করেন,হৃদয় আর হৃৎপিণ্ড একই জিনিস;কিন্তু আসলে তা নয়। হৃৎপিণ্ড সম্পর্কে বলা যায়,এটি একটি মাংসপিণ্ড আর হৃদয় হচ্ছে একটি চেতনাগিত অস্তিত্ব-যাকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না; তবে এটি আমাদের অনুভূতিতে সাড়া দেয় ও প্রভাবিত হয়।
আমরা জেনেছি,পাম্প করে সারা শরীরে রক্ত পাঠানোই হৃৎপিণ্ডের অন্যতম প্রধান কাজ। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো,হৃৎপিণ্ডের নিজের কোষ ও পেশিগুলোর সুস্থভাবে বেঁচে থাকা এবং কর্মক্ষম থাকার জন্যেও দরকার পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও পুষ্টি। এ পুষ্টি পৌঁছে দেয়ার কাজটি সাধিত হয় রক্তের মাধ্যমে। হৃৎপিণ্ডের রক্ত সরবরাহের গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে করোনারি ধমনী। হৃৎপিণ্ডের প্রধান দুটি করোনারি ধমনী হলো,যথাক্রামে বাম ও ডান করোনারি ধমনী বা লেফট করোনারি আর্টারি ও রাইট করোনারি আর্টারি ।লেফট করোনারি আর্টারি আবার একটিু নিচের দিকে এসে দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে-লেফট অ্যান্টেরিয়র ডিসেন্ডিং আর্টারি (েএলএডি)ও লেফট সারকামফ্লেক্স আর্টারি (এলসিএক্স)।
করোনারি আর্টারি ডিজিজ
হৃৎপিণ্ডের অনেক ধরনের রোগ হয়ে থাকে। এর মধ্যে বর্তমানে সারা পৃথিবীতে যে রোগটি সবচেয়ে ভাবনার কারণ হযে দাঁয়িয়েছে সেটি হলো,করোনারি আর্টারি ডিজিজ (Coronary artery disease)।
ভুল জীবনযাপনের ফলে করোনারি ধমনীর ভেতরের দেয়ালে কোলেস্টেরল প্লাক বা হলুদ চর্বির স্তর জমে। এতে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়।
যার করণে হৃৎপিণ্ডের কোষগুলোতে রক্তের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন ও পুষ্টি পৌঁছাতে পারে না। ফলে রোগী একসময় বুকে ব্যাথা অনুভব করে। রক্ত চলাচল কমে গিয়ে এ সমস্যাটি দেখ দেয় বলে একে ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজও বলা হয়ে থাকে।
করোনারি হৃদরোগজনিত এ ব্যথটি চিকিৎসাশাস্ত্রে এনজাইনা (Angina) নামে পরিচিত। অধিকাংশ রোগীই এ সময় বুকের মধ্যে ভার ভার বা এক ধরনের চাপ অনুভব করেন। মূলত বুকের বাম দিকে বা বুকের মাধ্যখানে এই ব্যাথা অনুভূত হয়। কখনো কখনো শ্বাসকষ্টও অনুভব হতে পারে। বুকের এই ব্যথা সাধারণত ঘাড়,থুতনি,ওপরের পিঠ,বাহু ,বিশেষ করে বাম হাত বা কব্জিতেও ছড়িয়ে যেতে পারে । কখনো কখনো ওপরের পেটেও এ ব্যথা হতে পারে,যা সবচেয়ে বিপজ্জনক।
মনে হবে এসিডিটি ।রেনিটিডিন বা ওমিপ্রাজল জাতীয় ওষুধও হয়তো একটি খেয়ে নিলেন। তবু কমছে না , বরং কিছুটা যেন বাড়ছে। একমসয় দেখা গেল,আপনার হার্ট অ্যাটাক এবং ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কখনো কখনো হার্ট অ্যাটাকের অন্যম চিত্র এটি। অর্থাৎ হার্ট অ্যাটাক হতে যাচ্ছে আপনি মনে করছেন এসিডিটি বা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা।
আবার এমনও নয় যে,অরোনারি হৃদরোগ হলে সবসময় আপনার ব্যথা হবে। অনেক রোগী আছেন,যাদের করোনরি ধমনীতে হয়তো ৭০/৮০/৯০শতাংশ ব্লকেজ,কিন্তু কখনোই ব্যথা অনুভব করেন নি। তিনি হয়তো প্রথমবারের মতো ব্যথা অনুভব করেন,যেদিন তার হার্ট অ্যাটাক হয়।
করোনারি হৃদরোগ মূলত এনজাইনা পেকেটোরিস (Angina Pectoris) ও মায়োকর্ডিয়াল ইনফার্কশন (Myocardial Infarction) এ দু’ধরণের।
করোনারি ধমনীতে চর্বি জমে ব্লকেজ সৃষ্টি হতে শুরু করলে এর মধ্য দিয়ে রক্ত চলাচল কমে আসে। যার ফলে হৎপিণ্ডের সে নির্দিষ্ট অংশে পর্যাপ্ত রক্ত সরবরাহ হতে পারে না এবং হৃৎপিণ্ডের কোষগুলো বঞ্চিত হয় প্রয়োজনীয় আক্সিজেন ও পুষ্টি থেকে। তখন বুকে ব্যথা হতে শুরু করে। এটাই এনজাইনা পেকটোরিস।
আর এই ব্লকেজের পরিমাণ যদি বাড়তে বাড়তে শতভাগ হয়ে যায় এবং ধমনী-পথে রক্ত চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে আসে, তখনই হার্ট অ্যাটাক। চিকিৎসা পরিভাষায় যা মায়োকর্ডিয়াল ইনফার্কশন নামে পরিচিত। রোগী এ সময় বুকে তীব্র ও অসহনীয় ব্যথা অনুভব করেন। এ ব্যথা কখনো কখনো বুক,গলা,ঘাড়,ওপরের পেট,দুই হাত এবং পিঠেও চলে যেতে পারে । সাথে শ্বাসকষ্ট,বমি বমি ভাব বা বমি হতে পারে। রোগী ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং জরুরি চিকিৎসা নিতে ব্যর্থ হলে রোগীর মৃত্যুও ঘটতে পারে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানী,মনোবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীরা করোনারি হৃদরোগের জন্যে ঝুঁকিপূর্ণ কয়েকটি কারণকে বিশেষভাবে চিহিৃত করেছেন।
বয়স: বিজ্ঞানীরা বলছেন,বয়স যত বাড়তে থাকে হৃদরোগের আশঙ্কাও তত বাড়তে থাকে। আমরা যদি দেখি,হৃদরোগ সাধারণত কোন বয়সে হয়? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটি হয় চল্লিশ বছর বয়সে এসে বা তার পরে।
লিঙ্গভেদে: হৃদরোগ হওয়ার প্রবণতা পুরুষদের তুলনামূরক বেশি। তবে মহিলাদের ক্ষেত্রে মেনোপজ অর্থাৎ ঋতুচক্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর হৃদরোগের আশঙ্কা বাড়তে থাকে। এছাড়াও মহিলাদের মধ্যে যারা নিয়মিত জন্মবিরতিকরণ ওষুধ সেবন করেন,তাদের করোনারি হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
জেনেটিক বা বংশগত: বাবা-মায়ের হৃদরোগ থাকলে তাদের সন্তানদেরও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। গবেষকদের মতে,এর মূল কারণ হচ্ছে পারিবারিক ভুল খাদ্যাভ্যাস ও ধূমপানের ইতিহাস। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,কারণ একজন মানুষ শৈশব থেকে প্রায় সব ব্যাপারই পারিবারিক রীতি ও আচার-ঐতিহ্যে অভ্যস্ত হয়ে উঠে।
খাদ্যাভ্যাসও চালু থাকে জীবনের শুরু থেকেই মানুষ সাধারণত সেই খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। তাই মূলত পারিবারিক ভুল খাদ্যাভ্যাস এবং ধূমপানই বংশগত হৃদরোগের অন্যতম কারণ।
ধূমপান: যুক্তরাষ্ট্রের নিনেসোটা ইউনিভর্সিটির স্কুল অব পাবলিক হেল্থ ও সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভর্সিটির এক যৌথ গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে,অল্প বয়সেই হার্টের রক্তনালী সংকুচিত হয়ে যাওয়া এবং হার্টে অ্যাটাকের জন্যে যেসব কারণকে দায়ী করা হয় তার মধ্যে ধূমপান আবস্থান শীর্ষে।
উচ্চ রক্তচাপ: করোনারি হৃদরোগের একটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কারণ হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ। ধমনীর ভেতর দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হওয়ার সময় এটি ধমনীর গায়ে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় চাপ দেয়। আর এই চাপটা যদি স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেড়ে যায়,সেটিই উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন।
অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ থাকলে করোনারি ধমনীর ভেতরের অংশে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। রক্তের মধ্যে থাকা অতিরিক্ত কোলেস্টেরল সেই ক্ষতের জায়গাটিতে আটকে যায়। এভাবে রক্ত চলাচলের পথে পরবর্তীতে আরো কোলেস্টরল একটু একটু করে সেই একই জায়গায় জমতে থাকে। যার ফলাফল করোনারি ব্লকেজ।
রক্তে কোলেস্টেরলের আধিক্য: হদরোগের আরেকটি ঝুঁকি হচ্ছে রক্তে কোলেস্টেরলের আধিক্য,যার অন্যতম কারণ ভুল খাদ্যাভ্যাস,ধূমপান ও শারীরিক পরিশ্রমের অভাব।
ডায়াবেটিস: ডায়াবেটিস একটি নীরক ঘাতক। শরীরের প্রায় সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ওপরই এর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। হৃৎপিণ্ডও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে করোনারি হৃদরোগের ঝুঁকি অনেক বেশি। ডায়াবেটিস একাই হৃদরোগের ঝুঁকিস বাড়ায় প্রায় ৩৩ শতাংশ। আর এর সাথে উচ্চ রক্তচাপ যোগ হলে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৬ শতাংশে।
অতিরিক্ত ওজন এবং মেদস্থুলতা: অতিরিক্ত ওজন যাদের,তাদরে শরীরে রক্ত সরবরাহ করতে হৃৎপিণ্ডকে তুলনামূলক বেশি কাজ করতে হয়।এটিও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায় । মূলত খাবার থেকে পাওয়া ক্যালরির পরিমাণ ও এই ক্যালরি ব্যবহারে অসামঞ্জস্যতাই অতিরিক্ত ওজনের কারণ । এটিও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায় । মাত্রাতিরিক্ত ওজনের ফলে উচ্চ রক্তচাপ,কোলেস্টরলের আধিক্য ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও বেড়ে যায় অনেকগুণ ।
শারীরিক পরিশ্রমের অভাব: আধুনিক ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধাপূর্ণ জীবনে সবাই আমরা কমবেশি গা ভাসিয়ে দিয়েছি। অথচ শারীরিকভাবে নিষ্ক্রিয় ও পরিশ্রমহীন অলস জীবনযাপনে অভ্যস্ত যারা,তাদের অকালমৃত্যু ও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার হার কায়িক পরিশ্রমে অভ্যস্তদের চেয়ে তুলনামূলক বেশি। তাই হয়তো বলা হয়ে থাকে‘যত আরাম তত ব্যারাম।
অবশ্য করোনারি হৃদরোগের কারণ আলোচনায় এটাই শেষ কথা নয়;চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোও তা-ই বলছে। কারণ,কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা যায়,অতিরিক্ত ওজন,উচ্চ রক্তচাপ,ডায়াবেটিস কিংবা মাত্রাতিরিক্ত কোলেস্টেরল –এসব কোন সমস্যাই নেই ,অথচ তিনি করোনারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন। আবার দেখা গেল,৮০ বছর বয়সেও বাবার হৃদযন্ত্র দিব্যি সুস্থ,কিন্তু ছেলের ৪০ না পেরোতেই হার্ট অ্যাটাক।
এছাড়াও জীবন সম্পর্কে আমাদের ভুল দৃষ্টিভঙ্গি অর্থাৎ ভ্রান্ত জীবনদৃষ্টি এবং এ থেকে সৃষ্টি স্ট্রেস বা মানসিকি চাপ,যাকে আমরা সহজ ভাষায় বলতে পারি টেনশন। পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে এ বিষয়টি আমাদের কাছে ধীরে ধীরে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে।