অধিকাংশ মায়েদের একটি অভিযোগ হচ্ছে; আমার বাচ্চা খেতে চায় না’ দূরে বা কাছে অথবা আড্ডায় এবং টেলিফোনে সব মা-বাবার একই অনুযোগ আমার বাচ্চা খেতে চায় না।
বাচ্চা দুষ্টুমি করছে, খেলছে, হাসছে কিন্তু খেতে চাইছে না। জোরকরে দিলে মুখ থেকে বমি করে ফেলে দিচ্ছে। খাবার গ্রহণে শিশুর এই অনিহা কেন? কেন শিশু খেতে চায় না?
অনেক মা প্রায়শই আমাকে বলেন; আমার বাচ্চা খাবার মুখে নিয়ে বসে থাকে গিলে না আবার কেউবা বলেন; আমার বাচ্চা শুধু চিপ্স এবং কোক খেতে চায়।
অন্য একজন বলেন; আমার বাচ্চা চিপস, চকলেট, সস আর ফাষ্টফুড পাগল।
কেউ বা বলেন বিজ্ঞাপন বা গান না দেখালে বাচ্চা খায় না।
এখন আমার প্রশ্ন হল বাচ্চারা তো বিজ্ঞাপন, চা, কোক, চিপস, চকলেট, সস, ফাষ্টফুড চিনে না ওকে এসব খাইয়ে অভ্যাস করেছেন কেন?
আসলে অনেক মায়েরা তাদের বাচ্চাদের খাবার নিয়ে একটুবেশি চিন্তিত থাকেন বলে খাবারের ক্ষেত্রে কোন রুটিন মেনে চলেন না।
আর এই অনিমিয়ত খাদ্যাভ্যাসের দরুন ধীরে ধীরে খাবারের প্রতি অনীহা তৈরি হয়।
ক্ষুধা লাগলে শিশু খাবে এটা স্বাভাবিক; আর খাবার হজম হলেই শিশুর ক্ষিদে লাগবে।
যদি খাওয়ার সুনির্দিষ্ট সময় ছাড়া অন্য সময়ে শিশুকে কিছু খাওয়ানো হয়,
তবে যে সমস্যাগুলো দেখা দেয় তা হল-
১. যে খাবার পেটে আছে, তা ঠিকমতো হজম হবে না।
২. যে খাবার তাকে দেয়া হয় তা সে পুরোপুরি খাবে না, কারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার খিদে লাগেনি।
৩. খাবার দেয়ার ফলে তার যখন ক্ষিদে লাগার কথা ছিল, সেই খিদেটা তখন লাগবে না।
ফলে সে পরিমাণে আরো কম খাবে।
জোর করলেও কোনো লাভ হবে না।
বরং বমি ও অন্যান্য উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
শিশু খেতে না চাওয়ার কারণ :
শিশুর খেতে ‘না চাওয়া’টা মায়ের জন্য দুশ্চিন্তার বিষয়।
আবার শিশুর চিকিৎসকও যখন এই বিষয়টা খুব একটা আমলে নেয় না, তখন মায়ের জন্য সেটা হয়ে যায় অসহায়ত্বের বিষয়।
আসলে শিশুর এই খেতে না চাওয়াটা খুব সাধারণ একটি সমস্যা।
প্রতিটা শিশুই আলাদা আর তাদের খাবারের চাহিদাও ভিন্ন।
এমনকি একথাও বলা হয়ে থাকে, দিনভেদে একই শিশুর খাবারের প্রতি চাহিদা বা আগ্রহের রকমফের ঘটে।
মাঝেমধ্যে শিশু কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই তার জন্য বরাদ্দ খাবার খেয়ে ফেলে।
আবার অন্যদিন হয়তো একদমই খেতে চায় না। এতে মা-বাবা চিন্তিত হয়ে পড়েন।
ধারণা করে থাকেন যে এটা বুঝি শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশ কে বাধাগ্রস্ত করছে।
আসলে ব্যাপারটি তা নয়। আপনার বাচ্চা যদি স্বাভাবিক চলাফেরা ও খেলাধুলায় ক্লান্ত না হয়ে পরে তবে চিন্তার কোন কারণ নেই।
সাধারণত যেসব কারণে শিশু খেতে চায় না তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
১. জোরপূর্বক খাওয়ানো। জোর করে খাওয়ানোর ফলে শিশুর মধ্যে প্রচ-ভাবে খাদ্য অনিহা দেখা দেয়।
২. অনেক সময় শক্ত খাবার, অপছন্দের খাবার এবং একই খাবারের পুনরাবৃত্তি করে খাওয়ালে খাবারের প্রতি শিশুর অনীহা তৈরি হয় এবং
সে খাবার দেখলে ভয় পায় বা বমি করে ফেলে।
৩. ছোট শিশুদের ঘ্রাণেন্দ্রিয় বেশ স্পর্শকাতর।
খাবারের গন্ধ এবং রঙ যদি ভালো না হয় বাচ্চারা সে খাবার খেতে চায় না, মুখ থেকে ফেলে দেয়।
৪. অনেক সময় শরীরের জিনঘটিত কারণে কিছু কিছু খাবারের গন্ধ বা স্বাদ বাচ্চারা সহ্য করতে পারে না।
এর ফলে তারা সব ধরনের খাবার খেতে চায় না, বেছে বেছে খায়।
৫. হজম প্রক্রিয়াতে সমস্যা থাকায় অনেক বাচ্চার খিদে কম পায় এবং খাবার ইচ্ছা থাকে না।
এ কারণেও অনেক বাচ্চা খাবার নিয়ে বায়না করতে পারে।
৬. যেসব শিশুদের ঘন ঘন মুড পরিবর্তন হয়, তারা খাবার নিয়ে সমস্যা করে বেশি।
নিজের স্বাধীন মেজাজ বোঝানোর জন্য বা বজায় রাখার জন্য অনেক শিশু খাবার নিয়ে বায়না ও জেদ করতে থাকে।
৭. শিশুর খাবার না খেতে চাওয়ার পেছনে অনেক সময় সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার কাজ করে।
যেসব বাচ্চার মা অতিরিক্ত আদর বা শাসন করে, সে বাচ্চাদের মধ্যে খাবার নিয়ে ঝামেলা করার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
৮. অনেক মা শিশুকে নিয়মমাফিক খাওয়ানোর মাঝে কান্নামাত্রই মায়ের দুধ খাওয়ান বা অন্যান্য খাবার খাওয়ান।
এই অনিমিয়ত খাবারের দরুন শিশুর খাবারের রুচি ও ক্ষিধা নষ্ট হয়ে যায়। ফলে সে খাবার খেতে অনীহা প্রকাশ করে।
৯. কোনো কোনো বাড়িতে শিশু নিজের খাবার সময় ছাড়া অন্য সময়ও পরিবারের অন্যান্য সদস্য বা আত্মীয়-স্বজন সবার সাথে খায়।
আবার অনেক মা তার শিশু সাতটার সময় পেটভরে খায়নি বলে আটটার সময় তাকে আরেকবার খাবার দেন, নয়টার সময় আবার চেষ্টা করেন এবং এমনিভাবে সারাদিন ধরেই প্রচেষ্টা চলতে থাকে।
এসব অভ্যাসই শিশুর খাবারের প্রতি অনীহা তৈরি করে।
১০. মুখ ভর্তি করে খাবার দিলে অনেক সময় তার গিলতে সমস্যা হয়।
যার ফলে খাবার গ্রহণে শিশু অনীহা প্রকাশ করতে পারে।
শিশুকে খাওয়ানোর নিয়ম :
প্রকৃত পক্ষে শিশুর মূল খাদ্যাভ্যাস তৈরি করতে হবে ছয় মাস বয়স থেকে, যখন সে মায়ের বুকের দুধের পাশাপাশি পরিপূরক খাবার খেতে শুরু করে।
শিশুকে দৈনিক চার-পাঁচবার অল্প অল্প করে পরিপূরক খাবার খেতে দিতে হবে।
শিশুর পরিপূরক খাবার অবশ্যই সুষম হতে হবে। এজন্য সবজি, ডাল, মাছ বা মুরগির মাংস এবং তেল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে দেয়া যেতে পারে।
এছাড়া শিশুকে ডিম, সুজি পাশাপাশি বুকের দুধ খাওয়াতে হবে।
একটি শিশু যখন থেকে বাড়তি খাবার খেতে শিখে তখন থেকেই শিশুকে সব ধরনের খাবার খেতে অভ্যাস করতে হবে।
একটি শিশুর সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, শাকসবজি, ফলমূল সবকিছুই সমান গুরুত্বপূর্ণ।
তাই তাকে ছোটবেলাতেই এসব খাবার দিতে হবে।
এক বছর বয়স থেকে
শিশুর খাবারের পরিমাণ ও সময় নির্দিষ্ট করতে হবে।
কিছু দিন একই সময়ে খাওয়ালে শিশু এতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে।
দুই বছর পর্যন্ত শিশুর মস্তিষ্কের বৃদ্ধি ঘটে, তাই এ সময় শিশুকে পর্যাপ্ত প্রোটিনজাতীয় খাবার দিন।
দুই বছর বয়স থেকে
শিশুকে নিজ হাতে খাওয়ানোর অভ্যাস করতে হবে।
প্রথম প্রথম নষ্ট করলেও একসময় সে নিজেই খাওয়া শিখবে।
দুই বছর বয়স থেকে তিনবেলা মূল খাবারের পাশাপাশি সকাল, দুপুর ও বিকালে নাশতা হিসেবে মৌসুমী ফল, দুধ, পুডিং ইত্যাদি খেতে দেয়া যেতে পারে।
শিশুর খাবার এমনভাবে পরিবেশন করতে হবে, যাতে সে সহজে খেতে পারে।
মাংস ছোট ছোট টুকরো করে দিতে হবে। ফলও কেটে ছোট টুকরো করে দিতে হবে।
শিশুর খাবার থালা, বাটি, চামচ তার উপযোগী অর্থাৎ রঙিন ও আকারে ছোট হলে শিশু খেতে আকৃষ্ট হবে।
পরিবারের সবার সঙ্গে শিশুকে খেতে দিতে হবে।
পরিবারে একাধিক শিশু থাকলে তাদের একসঙ্গে খেতে দিলে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উৎসাহী হয়ে তারা খাওয়া শিখবে।
বাহিরের কোন খাবার বাচ্চাকে খাওয়ানো যাবে না।
বাচ্চারা অনেক বেশি খাবার গ্রহণ করতে পারে না তাই ওদের খাবারটা পরিমাণে অল্প কিন্তু উচ্চক্যালোরি সম্পন্ন হবে।
বাচ্চাদের টেলিভিশন, কম্পিউটার, মোবাইল আর গেইম থেকে দূরে রাখতে হবে।
তাকে কিছু খেলনা দিতে হবে যা খেললে শারিরিকভাবে তার শক্তি খরচ হবে এবং ক্ষুধা বৃদ্ধি পাবে।
খাবার দেবার সময় খাবারের গ্রহণযোগ্যতা বিচার করতে হবে।
খাবার বাসি, ঠা-া বা বেশি গরম যেন না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
বাচ্চাকে খাবার দেয়ার পূর্বে খাবারের চিনি আর লবণ পরীক্ষা করতে হবে।
বাচ্চাকে যা খাওয়াবেন তা বাসায় তৈরি করার চেষ্টা করতে হবে। খাবার সুন্দরভাবে পরিবেশন করতে হবে।
শিশুর খাওয়ার সময় তাকে গল্প বলে, ছড়া বলে খাওয়াতে আকৃষ্ট করতে হবে।
অনেক সময় বেশি খাবার দেখলে বাচ্চারা বিরক্ত হয় তাই অল্প অল্প করে খাবার দিন।
যখন পরিবারের কাউকে খেতে দেখলে বাচ্চা খেতে চায় তাই পরিবারের সকল সদস্য যেই সময় খাবার গ্রহণ করে সেই সময় শিশুকে সাথে নিয়ে খাবার খাওয়া উচিৎ, যাতে করে
পরিবারের খাবারের টেস্টের সাথে শিশুটি খাপ খাওয়াতে পারে।
এতে অন্যদের দেখে সে খাওয়া শিখবে এবং তার খাদ্যাভ্যাস তৈরি হবে।
বাচ্চাকে যখন খাওয়াবেন ওর খাবারের প্রতি পূর্ণ আগ্রহ রাখুন এবং তার সাথে নিজে খাওয়ার অভিনয় করুন।
মায়েদের প্রতি উপদেশ :
শিশুকে কখনও জোর করে কিংবা বকা দিয়ে বা মারধর করে খাওয়ানো যাবে না।
উৎসাহ দিয়ে, প্রশংসা করে শিশুকে খাওয়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, কোনো কোনো সময় শিশুর বৃদ্ধির গতি কিছুটা কমে আসে অথবা শিশু মাঝেমধ্যে খেলাধুলা কমিয়ে দেয়।
সেসব সময় শিশুর খাবারের চাহিদাও কমে আসে।
* শিশুকে তার বয়স অনুযায়ী খাবার খেতে দিন।
* মূল খাবারের মধ্যবর্তী সময়ে বাচ্চাকে স্ন্যাকস জাতীয় খাবার মূল খাবারের পরিমাণের বেশি খেতে দেবেন না।
* বাচ্চাকে সব ধরনের খাবার খেতে উৎসাহ দিন। সাধারণ খাবারও সুন্দর করে সাজিয়ে দিলে শিশু খাবার খেতে আগ্রহী হবে।
* অনেক সময় বাচ্চারা খাবার খেতে খেতে জামাকাপড় নোংরা করে ফেলে।
এমন করলে তাকে মারবেন না বা বকবেন না। শিশুকে তার নিজের মতো করে খেতে দিন।
* একটু বড় হয়ে গেলে শিশুকে একা একা খেতে দিন। ফেলে ছড়িয়ে খাবে বটে, তবে অভ্যাস গড়ে উঠবে।
* খাবার খাওয়ার আগে বা পরে বাচ্চাদের বিস্কুট, চকোলেট, চিপস, কোমল পানীয় আইসক্রিম ইত্যাদি দেবেন না এসব জিনিস বাচ্চাদের খাবার রুচি নষ্ট করে দেয়।
* খেয়াল রাখুন যেন খাবারের আইটেম প্রতিদিন একই রকম না হয়ে যায়, কারণ বাচ্চারা সবসময় একরকম খাবার খেতে বিরক্তবোধ করে।
তারা খাবারে নতুনত্ব চায়। তাই মাঝে মাঝে খাবারে পরিবর্তন আনুন।
*খাবার দেবার শুরুতেই আপনার বাচ্চা পিপাসার্ত কি না তা খেয়াল করুন।
পিপাসার্ত বাচ্চা কখনো খাবার খেতে চাইবে না।
তাই প্রথমে তাকে পানি খেতে দিন আর তার কিছুক্ষণ পর খাবার খেতে দিন।
এতে ক্ষিধে আর হজম শক্তি দুই-ই বাড়বে!
* শিশু খেতে চাইছে না বা খাচ্ছে না-এ অজুহাতে তাকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় খাবার দেবেন না।
শিশুকে খাওয়াবার ব্যাপারে তাড়াহুড়া করবেন না…হাতে সময় নিয়ে শিশুকে খাওয়াতে হবে।
শিশুকে লোভ দেখানো যাবে, প্রশংসা করতে হবে-কিন্তু জোর করা যাবে না।
* বাচ্চার ক্ষুদা পাবার জন্য সময় দিতে হবে।
খাবার নিয়ে শিশুর পেছনে দৌড়ানো বন্ধ করতে হবে।
* শিশুকে খাবার খাওয়ার সময় আনন্দ দিতে চেষ্টা করুন।
মজার গল্প বলে খাওয়ান বাচ্চারা গল্প শুনতে খুব ভালোবাসে। গল্প বলে খাওয়ালে দেখবেন সে বেশ আগ্রহ সহকারেই খাচ্ছে।
তবে সেটা প্রতিদিন করতে যাবেন না। একদিন গল্পের ছলে তো আরেক দিন খেলার ছলে খাওয়াতে পারেন।
* যদি দেখেন সে এমনিতেই খাচ্ছে তাহলে তার মত করেই খেতে দিন।
ছোট বাচ্চাদের খেতে দেয়ার সময় তাদের প্রিয় খেলনা কাছে রাখুন।
* প্লেটে পরিমিত খাবার দিন। বাচ্চার প্লেটে ততটাই খাবার দিন যতটা বাচ্চা একবারে খেতে পারবে।
* বাচ্চা খায়না বলে তা নিয়ে বাচ্চার সামনে সমালোচনা করা যাবে না, অভিযুক্ত করা যাবে না এবং বিরক্তভাব প্রকাশ করা যাবে না।
মনে রাখবেন ক্ষুদা পেলে সে নিজেই খাবে বা খাবার চাইবে।
আর বাচ্চা ছোট হলেও তার নিজস্ব পছন্দ অপছন্দ থাকতে পারে খাবারের ব্যাপারে।
খাবার সুস্বাদু না হলে আমাদের যেমন খাবার প্রতি আগ্রহ কমে যায় বাচ্চার জন্যও কিন্তু ব্যাপারটা একই।
তাই পুষ্টিকর খাবার যেন সুস্বাদু হয় তা খেয়াল রাখবেন।
একটু কষ্ট করে ঠিক মত পুষ্টিকর খাবার খাওয়ালেই দেখবেন আপনার সন্তান সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেড়ে উঠবে।
ষ সেলিনা বদরুদ্দিন
চিফ ডায়েটিশিয়ান
আজগর আলী হসপিটাল
গেন্ডারিয়া, ঢাকা। ০১৭১৫৮৪০৯১২