আপনার দেহের ভেতরেই আরেকটা প্রাণ ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে ! কী এক্সাইটিং অনুভূতি , তাই না ? প্রথমে কিছুই ফিল করা যায়না , এরপর আপনার মনোভাবে পরিবর্তন আসে । তারপর মর্নিং সিকনেস । দেখতে দেখতে বাচ্চা পেটের ভেতরে নড়াচড়া শুরু করে ।
প্রেগনেন্সির সময়টাকে তিন মাস করে ভাগ করা হয় যাকে Trimesters বলে । প্রতিটা Trimesters আপনার এবং আপনার গর্ভের শিশুর পরিবর্তন এবং গ্রোথ কীভাবে হবে তা নিশ্চয়ই জানতে বুঝতে ইচ্ছা করে । চলুন
প্রথম তিন মাসে মায়ের দেহে পরিবর্তন সমূহ :
একজন নারীর শরীরে গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসে কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায় । হরমোনের পরিবর্তনের কারণে শরীরের প্রতিটা অঙ্গেই প্রভাব পড়ে । পরিবর্তনগুলো বাহ্যিকভাবে প্রকাশ না হলেও শরীরের অভ্যন্তরে হয় ।
প্রেগনেন্সি হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধির ফলে বমিবমি ভাব ও বমির সমস্যা দেখা দিতে পারে । কারো কারো বিভিন্ন জিনিসের গন্ধের প্রতি সংবেদনশীলতা দেখা দেয় । এছাড়াও যে লক্ষণগুলো দেখা যায় তা হল – অত্যন্ত দুর্বল অনুভব করা , স্তন নরম হওয়া ও ফুলে যাওয়া , পেট খারাপ হওয়া , খাবারে অরুচি বা খুব বেশি ক্ষুধা পাওয়া , মেজাজের পরিবর্তন , কোষ্ঠকাঠিন্য , বুক জ্বালাপোড়া করা , ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া , মাথাব্যথা ইত্যাদি ।
প্রথম তিন মাসে ভ্রূণের বৃদ্ধি :
আমেরিকান কলেজ অফ অবসটেট্রিশিয়ান এন্ড গাইনেকোলজিস্ট (ACOG) এর মতে , গর্ভাবস্থার প্রথম মাসে বাচ্চার হৃদপিণ্ড ও ফুসফুসের গঠন হওয়া শুরু হয় । এই সময়েই বেবির হাত , পা , মস্তিষ্ক , স্নায়ুরজ্জু এবং স্নায়ুর গঠন ও শুরু হয়ে যায় ।
ভ্রূণের আকার তখন হয় একটি মটর দানার মত । দ্বিতীয় মাসে ভ্রূণের আকার বৃদ্ধি পেয়ে শিমের বিচির মত হয় । গোড়ালি , কব্জি , আঙ্গুল ও চোখের পাতা গঠিত হয় । হাড়ের প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথে যৌনাঙ্গ এবং অন্তঃকর্ণ এরও বিকাশ শুরু হয় ।
দ্বিতীয় মাসের শেষের দিকে ভ্রনের ৮-১০ টি প্রধান অঙ্গ গঠিত হয় । গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসেই গর্ভপাত হয় ও ভ্রূণের জন্মগত ত্রুটি দেখা দিতে পারে । তাই এই সময়ে ক্ষতিকর কোন ঔষধ গ্রহণ করা উচিৎ নয় ।
গর্ভাবস্থার তৃতীয় মাসে হাড় ও পেশীর বৃদ্ধি শুরু হয় । ভবিষ্যৎ দাঁতের জন্য ভিত্তি তৈরি হয় এবং হাত ও পায়ের আঙ্গুলের বৃদ্ধি হয় । এই সময়ে অন্ত্রের গঠন শুরু হয় এবং ভ্রূণের ত্বক প্রায় স্বচ্ছ থাকে ।
গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় তিন মাসে মায়ের দেহে পরিবর্তন সমূহ :
এই সময়ে মায়ের এনার্জি লেভেল কিছুটা বৃদ্ধি পায় । ভ্রুনের বিকাশের সাথে সাথে নারীর শরীরের সামনের অংশের ওজন বৃদ্ধি পেতে থাকে বলে পিঠে ব্যথা হতে পারে । ১৬-১৮ সপ্তাহে ভ্রূণের প্রথম নড়াচড়া টের পাওয়া যায় ।
দ্বিতীয় তিন মাসে ভ্রূণের বৃদ্ধি :
গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় তিন মাসে গর্ভস্থ ভ্রূণের অনেকটা বৃদ্ধি হয় । এই সময়ে ভ্রুন ৩-৫ ইঞ্চি লম্বা হয় । যদি হবু বাবা-মা আগাম জানতে চান তাহলে ১৮-২২ সপ্তাহে আল্ট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে ভ্রূণের লিঙ্গ জানা যায় ।
গর্ভাবস্থার ৪ মাসের সময় ভ্রু , পাপড়ি , নখ এবং ঘাড় গঠিত হয় । এই সময়ে ভ্রূণের ত্বক কুঞ্চিত থাকে এবং হাত ও পা বাঁকা করতে পারে । কিডনি কাজ করা শুরু করে এবং প্রস্রাব উৎপাদন করতে পারে । গর্ভস্থ শিশু ঢোক গিলতে এবং শুনতে পারে ।
পঞ্চম মাসে ভ্রুন সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং মা তার নড়াচড়া অনুভব করতে পারেন । এই সময়ে গর্ভস্থ শিশু নিয়মিত সময়ে ঘুমায় ও জেগে উঠে । সূক্ষ্ম লোম গজায় যাকে ল্যানুগো বলে এবং ভ্রূণের ত্বকের সুরক্ষায় মোমের আবরণ তৈরি হয় , যাকে ভারনিক্স বলে ।
ছয় মাসে ভ্রূণের চুল উৎপন্ন হওয়া শুরু হয় , চোখ খোলা শুরু করে এবং মস্তিষ্কের বিকাশ খুব দ্রুত হয় । ফুসফুস পুরোপুরি গঠিত হয়ে গেলেও কাজ করা শুরু করেনা ।
গর্ভাবস্থার শেষ তিন মাসের (১৩-২৭ সপ্তাহ) পরিবর্তন সমূহ :
গর্ভাবস্থার তৃতীয় তিন মাসে গর্ভবতী নারীর জরায়ু বড় হয়ে ডায়াফ্রামে চাপ সৃষ্টি করে (ডায়াফ্রাম হচ্ছে বুক ও পেটের মাঝামাঝি অবস্থিত পেশী যা শ্বাস নেয়া ও নিঃশ্বাস ছাড়ার সাথে জড়িত) । ফুসফুস পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রসারিত হতে পারেনা বলে শ্বাসকষ্ট হয় । গর্ভবতী নারীর গোড়ালি , হাত , পায়ের পাতা এবং মুখ ফুলে যায় তরল জমা হওয়ার কারণে । রক্ত সংবহন ও ধীর গতির হয় । মুখের ত্বকে কালো দাগ পড়তে পারে এবং পেট , উরু , ব্রেস্ট ও পেছনে স্ট্রেচ মার্ক দেখা দেয় ।
শেষ তিন মাসে ভ্রূণের বৃদ্ধি :
গর্ভাবস্থায় সপ্তম মাসে গর্ভস্থ শিশু পদাঘাত করে এবং আলো ও শব্দের প্রতি প্রতিক্রিয়াশীল হয় । সে চোখ খোলে ও বন্ধ করে ।
গর্ভস্থ শিশুর শরীরে অত্যাবশ্যকীয় খনিজ আয়রন ও ক্যালসিয়াম সংরক্ষণ শুরু হয়ে যায় । ল্যানুগো পড়ে যাওয়া শুরু হয় ।
আট মাসের সময় ভ্রুন খুব দ্রুতই ওজন লাভ করে । শরীরের হার শক্ত হতে থাকলেও মাথার খুলি নমনীয় থাকে প্রসব সহজ হওয়ার জন্য । মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চল গঠিত হয় এবং ভ্রুন হেঁচকি তুলতে পারে ।
শিশুর দেহের মোমের আবরণ বা ভারনিক্স মোটা হতে থাকে । গর্ভস্থ শিশুর শরীরে ফ্যাট বৃদ্ধি পায় । ফলে তার আকার বড় হতে থাকে এবং নড়াচড়া করার স্থান কমে যায় । নড়াচড়ার গতি কমে গেলেও মা নড়াচড়া অনুভব করতে পারেন ঠিকই ।
নবম মাসে ভ্রূণের আবাসস্থল প্রসারিত হয় এবং জন্মের জন্য ভ্রুনের মাথা শ্রোণি অঞ্চলের নীচের দিকে ঘুরে যায় (হেড ডাউন পজিশন) । ফুসফুস তার কাজ পরিচালনার জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হয়ে যায় । ভ্রূণের ওজন দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে । জন্মের সময় বাচ্চার ওজন ৬ পাউন্ড ২ আউন্স বা ৯ পাউন্ড ২ আউন্স থাকতে পারে এবং বাচ্চা ১৯-২১ ইঞ্চি লম্বা হতে পারে ।
পরিশিষ্ট –
প্রতি ট্রাইমেস্টারে কী ঘটে এটা আগে থেকেই জানা থাকলে আপনি আপনার নিজের দেহের অস্বস্তি যেমন – (বমি , দুর্বলতা) সম্পর্কে আগে থেকেই ওয়াকবিহাল থাকছেন । ফলে অযথা টেনশন এড়াতে পারবেন। অন্যদিকে গর্ভের শিশুর গঠন কেমন হচ্ছে তা জানতে পারবেন । হয়তো ভেবে আনন্দ পাবেন , এখন আমার বেবি চোখ খুলতে পারে !
তবে এখানেই আপনার দায়িত্ব শেষ নয় । গর্ভাবস্থায় অবশ্যই নিয়মিত ডাক্তার ফলোআপে থাকবেন । এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চলবেন । আপনার ও আপনার অনাগত বেবির জন্য অনেক শুভকামনা রইল ।